বুধবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৫

শুধুমাত্র তুলসী পাতার ব্যবহার করে সমাধান করুন ৬ রকমের শারীরিক সমস্যা by তত্ত্বরসামৃত জ্ঞানমঞ্জরী


 

শুধুমাত্র তুলসী পাতার ব্যবহার করে সমাধান করুন ৬ রকমের শারীরিক সমস্যা

 by তত্ত্বরসামৃত জ্ঞানমঞ্জরী
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা স্কুল's photo.
সেই প্রাচীনকাল হতেই নানা শারীরিক সমস্যা সমাধানে ব্যবহার হয়ে আসছে তুলসী পাতা। তুলসী পাতার ঔষধি গুণের কারণে এটি বহুকাল ধরেই সমাদৃত ঘরোয়া চিকিৎসায়। ছোটোখাটো নানা শারীরিক সমস্যা থেকে শুরু করে মারাত্মক দৈহিক সমস্যাও দূর করতে কার্যকরী এই তুলসী পাতা। আজ জেনে নিন শুধুমাত্র তুলসী পাতার ব্যবহারে নানা শারীরিক সমস্যা সমাধানের দারুণ উপায়গুলো।
১) গলাব্যথা ও সর্দি কাশি দূর করে
ঋতু পরিবর্তনের সময় ঠাণ্ডা লেগে সর্দি কাশি হয়ে যায় এবং গলা ব্যথার সমস্যাও দেখা দেয়। এই সমস্যা দূর করবে শুধুমাত্র তুলসীপাতা। নিয়মিত তুলসী পাতার রস পান করলে ও তুলসী পাতা ফোটানো পানি দিয়ে গার্গল করলে দ্রুত সমস্যার সমাধান পাবেন।
২) মাথাব্যথা উপশম করে
অনেক সময় মানসিক চাপ, মাইগ্রেন বা অন্যান্য অনেক কারণেই মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়। মাথাব্যথা থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে শুকনো তুলসী পাতা পানিতে ফুটিয়ে এই পানির ভাপ নিন। খুব ভালো ফলাফল পাবেন।
৩) দাঁতের সমস্যা দূর করে
দাঁতের জীবাণু দূর করতে তুলসী পাতার অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদানের জুড়ি নেই। এছাড়াও মাড়ির ইনফেকশন জনিত সমস্যা দূর করে তুলসী পাতা। সমস্যা দূর করতে শুধুমাত্র তুলসী পাতা চিবিয়ে রস শুষে নিন।
৪) জ্বর নিরাময়ে
১ মুঠো তুলসী পাতা ২ কাপ পানিতে ফুটিয়ে মধু মিশিয়ে চায়ের মতো পান করলে নানা ধরণের জ্বর যেমন ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ইত্যাদি থেকে রক্ষা পেতে পারেন। এছাড়াও সাধারণ ঠাণ্ডা জ্বর হলে তুলসী পাতার চা তা দ্রুত নিরাময়ে সহায়তা করে।
৫) কিডনির সমস্যা দূরে রাখে
তুলসী পাতার রস দেহ থেকে ক্ষতিকর টক্সিন দূর করার ক্ষমতা রাখে। নিয়মিত তুলসী পাতার রস পান করলে কিডনির সমস্যা, কিডনি ড্যামেজ এমনকি কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কমে যায়।
৬) কানের ইনফেকশন দূর করে
অনেক সময় কানের বিভিন্ন কারণে কানের ইনফেকশনের সমস্যা দেখা দেয়। যদি প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা করতে চান তাহলে কানে কয়েক ফোঁটা তুলসী পাতার রস ফেলে দিন। তুলসী পাতার অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিইনফ্লেমেটোরি উপাদান কানের ইনফেকশন ও প্রদাহ দূর করবে।

শক্তিপীঠ বিমলা by কৃষ্ণকমল



শক্তিপীঠ বিমলা

 by কৃষ্ণকমল

কালিকাপুরাণ মতে, চার মহাপীঠ তন্ত্রসাধনার কেন্দ্র। এগুলির মধ্যে পশ্চিমদিকের পীঠটি হল ওড্ডীয়ন বা উড্ডীয়ন অঞ্চলের কাত্যায়নী। এই পীঠের ভৈরব জগন্নাথ। বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না, এই ওড্ডীয়ন বা উড্ডীয়ন হল আজকের ওড়িশা। আর এই কাত্যায়নী হলেন শ্রীক্ষেত্র জগন্নাথ ধামের রক্ষয়িত্রী দেবী বিমলা। পীঠশক্তি রূপে কাত্যায়নীর নাম পাওয়া যায় হেবজ্র তন্ত্র গ্রন্থেও। সেখানে তাঁকে বলা হয়েছে উড্র পীঠের ভৈরবী। আর সেখানেও ভৈরব হলেন জগন্নাথ।
দক্ষকন্যা সতীর উপাখ্যান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হিন্দুদের একাধিক পুরাণে ও লোককথায়। ব্রহ্মার মানসপুত্র দক্ষ প্রজাপতির ছিল আট মেয়ে। তাঁদের মধ্যে সবার বড়ো ছিলেন সতী। দক্ষ সতীকে শিবের হাতে সমর্পণ করেছিলেন। শিব শ্বশুরকে যথোচিত সম্মান করতেন না। বরং শ্বশুরের সামনেই তাঁর অশেষ গুণাবলির নিদর্শন স্থাপন করতেন। এজন্য দক্ষও তাঁর এই জামাইটির প্রতি বিশেষ সন্তুষ্ট ছিলেন না। সঙ্গে সঙ্গে সতীও হয়ে উঠেছিলেন বাবার বিশেষ অনাদরের পাত্রী। দক্ষ তাঁর অন্য মেয়ে-জামাইদের বাড়িতে ডাকতেন। কিন্তু শিব-সতীকে কখনই ডাকতেন না। সতীর বিয়ের কিছুদিন পরে দক্ষ এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। যথারীতি সেই যজ্ঞে তিনি অন্যান্য মেয়ে-জামাইদের আমন্ত্রণ জানালেন; শুধু ডাকলেন না শিব-সতীকে। সতী লোকমুখে জানলেন বাবার যজ্ঞ আয়োজনের খবর। তিনিও যজ্ঞস্থলে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। শিব বারণ করলেন। সতী শুনলেন না। অনাহত হয়ে সটান যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হয়ে দক্ষকে প্রশ্ন করে বসলেন, ‘বাবা, দেবাদিদেব মহাদেব কেন এই যজ্ঞে আমন্ত্রিত হননি?’ দক্ষ উত্তরে বললেন, ‘শিব সংহারের দেবতা। তাই তিনি অমঙ্গল বয়ে আনতে পারেন। তাছাড়া তাঁর বেষভূষাও ভদ্রজনোচিত নয়। তিনি শ্মশানচারী। ভূতপ্রেত তাঁর নিত্যসঙ্গী। সেই সব নগ্ন অনুচরবৃন্দের সম্মুখে তিনি নানান কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করে থাকেন। তাঁকে নিমন্ত্রণ করলে সমবেত সুধী দেবমণ্ডলীর সামনে আমাকেও অপ্রস্তুত হতে হবে। সেই কারণেই শিবকে এই যজ্ঞে নিমন্ত্রণ করা হয়নি।’ মঙ্গলময় জগদ্‌গুরু শিব। তায় তিনি তাঁর প্রাণের ঠাকুর। বাপের মুখে পতিনিন্দা সতীর প্রাণে শেলের মতো বিঁধল। যজ্ঞাগ্নিতে সতী-দেহ আহুতি দিলেন শিবানী। সতীর দেহত্যাগের সংবাদ পৌঁছালো দেবাদিদেবের কানে। ক্রোধে উন্মত্ত দেবাদিদেব বীরভদ্র, ভদ্রকালী প্রমুখ অনুচরবৃন্দকে দিয়ে দক্ষযজ্ঞ পণ্ড করালেন। কন্যার দেহত্যাগের কারণ দক্ষের মুণ্ডচ্ছেদ করলেন। তারপর সতীর অর্ধদগ্ধ দেহ কাঁধে তুলে উন্মত্তের মতো ছুটে বেড়াতে লাগলেন এলোক থেকে সেলোক। ত্রিভুবন ধ্বংস হওয়ার জোগাড় হল তাঁর ক্রোধের তেজে। তাই আসরে নামতে হল বিষ্ণুকে। সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ড খণ্ড করে ছড়িয়ে দিলেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে। সতীদেহের অন্তর্ধানে শান্ত হলেন শিব। বসলেন মহাধ্যানে।
এদিকে সতীর দেহের খণ্ডগুলি ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে জন্ম দিল এক এক মহাপীঠের। শক্তিপীঠগুলির সংখ্যা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। পীঠনির্ণয় ও তন্ত্রচূড়ামণি মতে পীঠের সংখ্যা ৫১। শিবচরিত মতে ৫১ পীঠ ও ৫১ উপপীঠ। আবার সর্বশ্রেষ্ঠ শাক্ত পুরাণ দেবীভাগবত মতে ১০৮ পীঠ। বিমলা শক্তিপীঠের উল্লেখ বেশ কয়েকটি প্রধান গ্রন্থে পাওয়া যায়। আবার এই পীঠকে একাধিক নামেও চিহ্নিত করার প্রবণতা দেখা যায়।
তন্ত্রচূড়ামণি গ্রন্থের ‘পীঠনির্ণয়’ বা ‘মহাপীঠনির্ণয়’ অংশে উৎকলের বিরজা ক্ষেত্রকে শক্তিপীঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই পীঠের শক্তি বিমলা ও ভৈরব জগন্নাথ। সতীর নাভি এখানে পড়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে এই গ্রন্থে। তন্ত্রচূড়ামণিগ্রন্থেই অন্য একটি অধ্যায়ে অবশ্য বিমলাকে উপপীঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এখানে সতীর উচ্ছিষ্ট পড়েছিল।তন্ত্রচূড়ামণি মন্দিরের অবস্থান উল্লেখ করতে গিয়ে ‘নীলাচল’ কথাটির উল্লেখ করেছে। নীলাচল বা নীলপর্বতের উল্লেখশিবচরিত গ্রন্থেও পাওয়া যায়। এই গ্রন্থেও বিমলা উপপীঠ। এখানকার শক্তি বিমলা ও ভৈরব জগন্নাথ। উল্লেখ্য, নীলাচল নামটি জগন্নাথ ক্ষেত্রের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে যুক্ত। সতীর উচ্ছিষ্ট পড়ার ঘটনার সঙ্গে জগন্নাথের উচ্ছিষ্ট ভোগে বিমলার পূজার কোনো যোগ থাকাও অসম্ভব নয়। তবে সেসব গবেষকদের আলোচনার বিষয়।
ফিরে আসি অন্যান্য তন্ত্র ও পুরাণ গ্রন্থগুলির আলোচনায়। কুব্জিকাতন্ত্র বলে, বিমলা ৪২টি সিদ্ধপীঠের একটি। এখানে সাধনা করলে সিদ্ধাই নামে এক ধরনের অলৌকিক ক্ষমতা লাভ করা সম্ভব। দেবীভাগবত পুরাণপ্রাণতোষিণী তন্ত্র ওবৃহৎ নীলতন্ত্র মতে, বিমলা ১০৮ শক্তিপীঠের অন্যতম। দেবীপুরাণ মতে, এখানে পড়েছিল সতীর পা। মৎস্যপুরাণ মতে, পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের বিমলা একটি শক্তিপীঠ। বামনপুরাণ মতেও এটি একটি মহাতীর্থ। মহাপীঠ নিরুপণ গ্রন্থে বিমলা ও জগন্নাথকে এই তীর্থের পীঠদেবতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মহাশক্তির ১০৮ পৌরাণিক নামের তালিকা নামাষ্টত্তরশতগ্রন্থেও পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের বিমলার উল্লেখ পাওয়া যায়।
এখানে একটি প্রশ্ন ওঠা খুব স্বাভাবিক। ‘ভৈরব’ শব্দটি ও শাক্ত-তান্ত্রিক শক্তিপীঠের ভৈরব ধারণাটির সঙ্গে সাধারণত যে দেবতার সম্পর্ক তিনি দেবাদিদেব মহাদেব। নারায়ণ বা কৃষ্ণ নন। রামানুজী বিশিষ্টাদ্বৈত বা চৈতন্য-অনুসারী গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনে পুরীর জগন্নাথ নারায়ণ বা কৃষ্ণের স্বরূপ। বিভিন্ন শাস্ত্রেও দেবী বিমলাকে কাত্যায়নী, দুর্গা, ভৈরবী, ভুবনেশ্বরী বা একানংশা দেবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নারায়ণ-পত্নী লক্ষ্মী বা কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি শ্রীরাধার সঙ্গে বিমলার কোনো সাদৃশ্য আদৌ দেখা যায় না। তবে কেন জগন্নাথকে ভৈরব বলা হল? কেনই বা তিনি দুর্গা-স্বরূপা বিমলার ভৈরব হলেন?
এর দুটি ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। একটি অদ্বৈত একেশ্বরবাদী ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যা অনুসারে, শিব ও বিষ্ণু অভিন্ন। তাই শিবশক্তি দুর্গা ও বিষ্ণুশক্তি লক্ষ্মীও অভিন্না। সেই অর্থেই জগন্নাথ বিমলার ভৈরব। তবে এই ব্যাখ্যা ততটা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, বিমলার সঙ্গে  শৈব-তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের যোগ যতখানি, অদ্বৈত সম্প্রদায়ের যোগ ততখানি নয়। তন্ত্র মতে, জগন্নাথ নারায়ণ বা কৃষ্ণের নয়, শিবের রূপ। সেই জন্যই তিনি শিব-ভৈরব। মনে হয়, এই কারণেই তন্ত্রগ্রন্থগুলিতে জগন্নাথকে ভৈরব আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আর তাই শাক্ত বিশ্বাসে দেবী বিমলা হয়ে উঠেছেন পুরুষোত্তম শক্তিপীঠের প্রধান দেবী তথা জগন্নাথ মন্দিরের রক্ষয়িত্রী।
এ তো গেল শাস্ত্রের কথা। কিন্তু ইতিহাস কী বলে?
ইতিহাস বলে, বিমলা মন্দিরের ইতিহাস সম্ভবত বৈষ্ণব জগন্নাথ-কাল্টের চেয়েও প্রাচীন। জগন্নাথ মন্দিরের বর্তমান কাঠামোটি খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর পরে নির্মিত। অথচ বর্তমান বিমলা মন্দিরটি খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে পূর্ব গঙ্গ রাজবংশের রাজত্বকালে নির্মিত। তাও প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের ফলে জানা গিয়েছে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত আদি বিমলা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপরই গড়ে উঠেছে নবম শতাব্দীর এই মন্দিরটি। জগন্নাথ মন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রোহিণীকুণ্ডের পাশে অবস্থিত বিমলা মন্দিরের সঙ্গে মন্দির চত্বরের মুক্তিমণ্ডপের কাছে অবস্থিত নৃসিংহ মন্দিরের স্থাপত্যগত মিলটি বেশ লক্ষণীয়। মাদলা পাঁজি বলছে, দক্ষিণ কোশলের সোমবংশী রাজবংশের রাজা যযাতি কেশরী এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা।  উল্লেখ্য, এই বংশের রাজা প্রথম যযাতি (খ্রিস্টীয় ৯২২–৯৫৫) ও দ্বিতীয় যযাতি (খ্রিস্টীয় ১০২৫–১০৪০) উভয়েই “যযাতি কেশরী” নামে পরিচিত ছিলেন। মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী–বিশেষত পার্শ্বদেবতাদের মূর্তি ও মূল মূর্তিটির পিছনের পাথরের খণ্ডটি সোমবংশী শৈলীর নিদর্শন বহন করে। হয়তো এগুলি আদি মন্দিরেরই অংশ ছিল। তাই বলাই যায়, চত্বরের প্রধান মন্দির জগন্নাথ মন্দিরের তুলনায় দেবী বিমলার মন্দির প্রাচীনতর।
খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে আদি শঙ্করাচার্য পুরীতে গোবর্ধন মঠ স্থাপন করেছিলেন বিমলাকে প্রধান দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। প্রথা অনুসারে, আজও গোবর্ধন মঠের অধ্যক্ষ পুরীর শঙ্করাচার্য বিমলা মন্দিরের প্রসাদ হিসেবে এক থালা মহাপ্রসাদ ও এক থালা খিচুড়ি ভোগ রোজ পেয়ে থাকেন। দ্য জগন্নাথ টেম্পল অ্যাট পুরী গ্রন্থের লেখক স্টারজার মতে, প্রাচীনকালে জগন্নাথ মন্দির ছিল ত্রিমূর্তি অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবপূজার কেন্দ্র। এই তিন দেবতার শক্তি তথা হিন্দুধর্মের প্রধান তিন দেবী সরস্বতী, লক্ষ্মী ও পার্বতীও তাই পূজিত হতেন জগন্নাথ মন্দিরে। তার মধ্যে দেবী পার্বতীর পূজা হত বিমলা রূপে। খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত পুরীতে শ্রীবিদ্যা উপাসনার প্রাবল্য লক্ষিত হয়েছে। পরবর্তীকালে বৈষ্ণবধর্ম জগন্নাথ মন্দির চত্বরে প্রাধান্য বিস্তার করে। কমে যায় শ্রীবিদ্যা ও শৈব-তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের প্রভাব। তবে এই প্রভাব একেবারেই অবলুপ্ত হয়নি। তান্ত্রিক পঞ্চমকার উপচারের বদলে বিমলা মন্দিরে নিরামিশ ভোগ ও দেবদাসী নৃত্যের প্রথা চালু হয়েছিল। তবে মাছভোগ দেবার প্রথাটি বজায় ছিল। রাজা নরসিংহদেব (শাসনকাল ১৬৩২–৪৭ খ্রিস্টাব্দ) মন্দিরে মাছ ও মাংস ভোগের প্রথা বন্ধ করে দেন। পরবর্তীকালে অবশ্য সেই প্রথা আবার চালু হয়। বর্তমানে বিমলা মন্দিরের জন্য সাধারণত আলাদা ভোগ রান্না করা হয় না। জগন্নাথের নিরামিশ ভোগই দেবী বিমলাকে নিবেদন করা হয়। শুধু দুর্গাপূজার সময় দেবীকে আমিষ ভোগ দেবার প্রথা রয়েছে। এই সময় খুব ভোরে গোপনে মন্দিরে পাঁঠাবলিও হয়। স্থানীয় মার্কণ্ড মন্দিরের জলাশয় থেকে মাছ ধরে এনে রান্না করে বিমলাকে নিবেদন করা হয়। পূজা হয় তন্ত্র মতে। এই সব অনুষ্ঠান ভোরে জগন্নাথ মন্দিরের দরজা খোলার আগেই সেরে ফেলা হয়। বৈষ্ণব ও স্ত্রী ভক্তদের এই সময় বিমলা মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। অনুষ্ঠানের অল্প কয়েকজন দর্শকই শুধু “বিমলা পারুষ” বা বিমলার আমিষ ভোগ পান। দেবী বিমলার ভক্তদের বিশ্বাস, দুর্গাপূজায় দেবী উগ্রমূর্তি ধারণ করেন। সেই সময় তাঁকে শান্ত করতে আমিষ ভোগ দিতেই হয়। যদিও এই মন্দিরে পশুবলি ও আমিষ ভোগ নিবেদন নিয়ে বৈষ্ণবদের আপত্তিও সুবিদিত।
বেলেপাথর ও ল্যাটেরাইটে নির্মিত বিমলা মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীটি কলিঙ্গ স্থাপত্যশৈলীর দেউল রীতির নিদর্শন। মন্দিরের চারটি অংশ: বিমান (গর্ভগৃহ যে অংশে অবস্থিত), জগমোহন (সভাঘর), নাটমণ্ডপ (উৎসবাদির স্থান) ও ভোগমণ্ডপ (ভোগ ও বিনোদনের স্থান)। এর মধ্যে বিমান অংশটি রেখ দেউল। এর আকার শম্বুকাকৃতির চিনির ডেলার মতো। বিমলা মন্দিরের বিমানটির উচ্চতা ৬০ ফুট। গায়ে নানারকম ছবি খোদাই করা। কেন্দ্রীয় গর্ভগৃহে রাখা আছে দেবী বিমলার মূর্তিটি। দেবী এখানে চতুর্ভূজা। তাঁর তিন হাতে জপমালা, বরমুদ্রা ও অমৃতকুম্ভ। চতুর্থ হাতের বস্তুটি ঠিক কী, তা নিয়ে মতান্তর দেখা যায়। তবে দেবী দুর্গার যে মূর্তি আমরা সচরাচর দেখতে অভ্যস্থ, দেবী বিমলার মূর্তি আদৌ সে রকম নয়। শুধু দেবী পার্বতীর দুই সখি জয়া ও বিজয়াকে দেবী বিমলার দুই পাশে দেখা যায়। মূর্তির উচ্চতা ৪ ফুটের কিছু বেশি।
বিমানের বাইরে জগমোহন, নাটমণ্ডপ ও ভোগমণ্ডপও নানারকম খোদাইচিত্রে শোভিত। বিমানে তিনটি কুলুঙ্গি আছে। তার একটিতে অষ্টভূজা মহিষমর্দিনী ও আর একটিতে ষড়ভূজা চামুণ্ডার মূর্তি দেখা যায়। তৃতীয় কুলুঙ্গিটি খালি। সম্ভবত সেখানকার দেবীমূর্তিটি চুরি গিয়েছে। জগমোহনের বৈশিষ্ট্য এর পিরামিড-আকৃতির ছাদ। নাটমণ্ডপে দশমহাবিদ্যা সহ মোট ষোলোজন হিন্দু দেবীর মূর্তি অঙ্কিত আছে। ভোগমণ্ডপের কুলুঙ্গিতে আছে অষ্টভূজ গণেষ ও ষড়ানন কার্তিকের মূর্তি। এছাড়া ভোগমণ্ডপের প্রবেশপথের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে দেবী বিমলার বাহন গজসিংহ – পরাজিত হাতির উপর দাঁড়ানো বিজয়দর্পে গর্বিত এক সিংহ।
২০০৫ সালে বিমলা মন্দির সংস্কার করা হয়েছে। বর্তমানে এটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ভুবনেশ্বর সার্কেল।
বিমলা মন্দিরের প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা। প্রতি বছর আশ্বিন মাসে ষোলোদিন ধরে মন্দিরে উদযাপিত হয় দুর্গাপূজা। পুরীর রাজা বিজয়াদশমীর দিন বিমলাকে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার রূপে পূজা করেন। এই মন্দিরের দুর্গাপূজার সবচেয়ে পুরনো উল্লেখটি পাওয়া যায়এখন নতুন দিল্লিতে রাখা কোণার্ক শিলালিপিতে (খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী)। এই শিলালিপির তথ্য অনুসারে, রাজা প্রথম নরসিংহদেব (রাজত্বকাল: ১২৩৮–১২৬৪) বিজয়াদশমীর দিন দুর্গা-মাধব (বিমলা-জগন্নাথ) পূজা করেছিলেন। হিন্দুধর্মের সনাতন বিশ্বাস, মেয়েরা কোমলস্বভাব। তাই বিমলার উগ্রমূর্তি মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা আজও দেখতে দেওয়া হয় না মেয়েদের।
বিমলা মন্দিরের একটি বৈশিষ্ট্য হল, জগন্নাথের প্রসাদী নারকেল বাটা, পনির ও মাখন দিয়ে শুকনো ভাত দিয়ে দেবী বিমলার নিত্যভোগের ব্যবস্থা। দুর্গাপূজার আমিষ ভোগ রান্নার ব্যবস্থা ছাড়া বিমলা মন্দিরের জন্য পৃথক ভোগ রান্নার ব্যবস্থা নেই। উচ্ছিষ্ট ভোগে হিন্দুধর্মে দেবদেবীর পূজা নিষিদ্ধ। তবে বিমলা মন্দিরে কেন এই ব্যবস্থা? ওড়িশায় একটি লোকশ্রুতি আছে এই নিয়ে। বৈকুণ্ঠে নারায়ণ-দর্শনে গিয়েছেন দেবাদিদেব মহাদেব। নারায়ণ তখন খেতে বসেছেন। মহাদেব দেখলেন, নারায়ণের থালা থেকে তাঁর ভোজ্যের কয়েক টুকরো উচ্ছিষ্ট পড়েছে মাটিতে। প্রসাদজ্ঞানে সেই উচ্ছিষ্ট তুলে মুখে দিলেন মহাদেব। সেসময় তাঁর অনবধানে কিছুটা লেগে রইল তাঁর দাড়িতে। কৈলাশে ফেরার পর মহাদেব দেখলেন, তাঁর পথ চেয়ে অপেক্ষা করে আছেন দেবর্ষি নারদ। নারদ দেখলেন মহাদেবের দাড়িতে লেগে আছে ভোজনাবশেষ। তিনি জানতেন, মহাদেব গিয়েছিলেন বৈকুণ্ঠে নারায়ণ-সন্দর্শনে। দুইয়ে দুইয়ে চার করলেন নারদ। তাঁর বুঝতে দেরি হল না, মহাদেব যাঁর শ্রেষ্ঠ ভক্ত, সেই নারায়ণেরই উচ্ছিষ্ট লেগে রয়েছে মহাদেবের দাড়িতে। তিনি চকিতে সেই উচ্ছিষ্ট তুলে নিয়ে মুখে দিলেন। ঘটনাটি নজর এড়ালো না শিবপত্নী পার্বতীর। ক্ষুণ্ণ হলেন তিনি। সোজা চলে এলেন বৈকুণ্ঠে। নালিশ জানালেন, নারায়ণ-প্রসাদে তাঁর ন্যায্য পাওনা থেকে দেবর্ষি তাঁকে বঞ্চিত করেছেন। তখন পার্বতীকে শান্ত করে নারায়ণ বললেন, “দেবী, দুঃখ কোরো না। কলিযুগে বিমলা রূপে নিত্য আমার প্রসাদ পাবে তুমি।” ভক্তেরা বলেন, সেই থেকে পুরীর মন্দিরে জগন্নাথের প্রসাদী অন্নে বিমলার পূজার নিয়ম।  উল্লেখ্য, জগন্নাথের প্রসাদ বিমলাকে উৎসর্গ করার পরই তা পায় মহাপ্রসাদের মর্যাদা।
শাক্ত সম্প্রদায়ের কাছে বিমলা মন্দির একটি মহাতীর্থ। ওড়িশাবাসী শাক্তদের কাছে বিমলা প্রধান শাক্ততীর্থ। তান্ত্রিকদের কাছে তো এই মন্দিরের গুরুত্ব মূল জগন্নাথ মন্দিরের চেয়েও বেশি।  জগন্নাথ মন্দিরের প্রথা অনুসারে, মূল মন্দিরে জগন্নাথকে পূজা করার বিমলাকে পূজা করা হয়।  প্রতিদিন এই মন্দিরের গর্ভমন্দির মুখরিত হয় শ্রীশ্রীচণ্ডী, আদি শঙ্করাচার্যের ‘দেব্যাপরাধক্ষমাপণ স্ত্রোত্র’ ও পুরুষোত্তম রক্ষিতের ‘বিমলাষ্টক স্তোত্রে’র সুরে। সন্তান আকুতি জানান, “মা, তোমার চরণসেবা করিনি কোনোদিন। কোনোদিন কিছুই ভালবেসে তুলে দিই নি তোমার হাতে। তবু আমাকে তোমার স্নেহের ছায়া থেকে কোনোদিন বঞ্চিত করোনি তুমি। আমি জানি, কুপুত্র জন্মায়, কিন্তু কুমাতা কখনও হয় না। আমার মতো পাপী আর কেউ নেই। তোমার মতো পাপঘ্নীও কেউ নেই। তাই হে জগজ্জননী, এরূপ জেনে যা উচিত তাই করো!”

(এই নিবন্ধটি লেখকেরই রচিত উইকিপিডিয়া নিবন্ধ অবলম্বনে অনুলিখিত। এটির সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত। লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্যত্র প্রকাশ আইনত নিষিদ্ধ। হিন্দু সংস্কৃতির প্রসার কল্পে অন্যত্র অবাণিজ্যিক প্রকাশের অনুমতি দেওয়া হয়। লেখকের সঙ্গে যোগাযোগের ঠিকানা (ফেসবুক): 

আত্মার বিজ্ঞান by কৃষ্ণকমল



     

আত্মার বিজ্ঞান

 by কৃষ্ণকমল
640Reincarnation
সমগ্র বিশ্ব এই ভ্রান্ত মোহে কর্মমুখর যে আমরা হচ্ছি এই দেহ। মানুষের সমগ্র কাজকর্মই তাদের জড় শরীরকে ঘিরে আবর্তিত হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় প্রথম যে বিষয়টি আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, তা হচ্ছে, “আমরা এই দেহ নই, আমরা চিন্ময় আত্মা।” এমনকি সামান্য একটু চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারব যে আমরা এই দেহ নই।
আত্মা প্রকৃ্তপক্ষে কি?
আত্মা হচ্ছে জীবনী শক্তির এক চিন্ময় স্ফুলিঙ্গ যা প্রত্যেকটি দেহকে ক্রিয়াশীল করে, সেটিকে বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ সম্পাদনে সক্ষম করে, ঠিক যেমন ইলেক্ট্রন কণার স্রোত তামার তারের মধ্যে প্রবাহিত হবার সময় শক্-এর সৃষ্টি করে। দেহকে একটি গাড়ীর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, আর আত্মাকে তুলনা করা যায় গাড়ীটির চালকের সংগে। আত্মা সেই জীবনের এক স্ফুলিঙ্গ, যার উপস্থিতির ফলে দেহকে জীবন্ত বলে মনে হয়, আর যখন আত্মা দেহটি ছেড়ে চলে যায়, তখন আমরা বলি যে লোকটি ‘মৃত’।
আত্মার অস্তিত্বের বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
আমারা কেবল জড় পদার্থ ও শক্তির সংগে সমন্বিতভাবে ‘বিজ্ঞান’ শব্দটিকে বুঝতে অভ্যস্ত। কিন্তু আরো এক উচ্ছতর মাত্রায় বিজ্ঞান রয়েছে, যা আত্মা ও অ-জড়, চিন্ময় শক্তি সম্বন্ধে আলোকপাত করে। আত্মা স্বরূপতঃ জড়াতীত, চিন্ময়, অপ্রাকৃত বস্তু। অন্য কথায়, আত্মা মূলগত ভাবেই জড় ইন্দ্রিয়ের প্রত্যক্ষণের পরিধির অতীত। জড়বিজ্ঞানের পরীক্ষা নিরীক্ষামূলক কলাকৌশলগুলি আত্মার অস্তিত্ব ‘প্রমাণ’ করার জন্য অপর্যাপ্ত, অনুপযুক্ত, ঠিক যেমন কানের দ্বারা আলোর অনুভব লাভের চেষ্টা বৃথা। কিন্তু অধ্যাত্ম-বিজ্ঞানের নিয়মবিধির অনুসরণের মাধ্যমে একে এক উচ্চতর বাস্তবতা বলে উপলব্ধি করা যায়। চরমে, সমগ্র পারমার্থিক সত্যই প্রকাশিত ও ‘প্রমাণিত’ হয় আভ্যন্তরিকভাবে, অনুভবের মাধ্যমে। তবু আত্মার উপস্থিতি উপলব্ধিতে নীচের বিষয়গুলি আমাদের সাহায্য করতে পারে।
১. সাধারণ জ্ঞান
যখন কেউ মারা যায়, আমরা বলি, “উনি চলে গেলেন।” এখন, কে চলে গেছেন? ব্যক্তিটির শরীর তো এখনো সেখানে শায়িত রয়েছে? সত্যটি হচ্ছে এই যে জীবনের উৎস আত্মা দেহটি ছেড়ে চলে গিয়েছে, এবং সেজন্য ব্যক্তিটিকে এখন বলা হচ্ছে মৃত।
২। স্বজ্ঞা-গত উপলব্ধি
আমাদের প্রত্যেকেরই একটি স্বজ্ঞাগত বোধ রয়েছে যে প্রকৃ্ত সত্তা বা ব্যক্তি, ‘আমি’ দেহ, মন ও বুদ্ধি থেকে আলাদা, পৃথক। আমরা বলি “আমার হাত,” “আমার মাথা” ইত্যাদি। এইভাবে আমরা দেহটির উপরের মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের ডগা পর্যন্ত ‘আমার এটা, সেটা’ বলে অভিহিত করতে পারি। এটি নির্দেশ করছে যে ঐসব বস্তুগুলি কোনো একজনের, কোনো মালিকের। চোখ, কান বা মস্তিষ্ক হচ্ছে কেবল কতকগুলি যন্ত্র, যেগুলির মাধ্যমে “আমরা” দেখি, শুনি, অথবা চিন্তা করি। এইসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি নিজেরা কোনো কিছু করতে পারে না। এমনকি একটি মৃতদেহেরও মস্তিষ্ক রয়েছে, কান রয়েছে, চোখ রয়েছে কিন্তু সেগুলি অকেজো, ক্রিয়াশক্তিরহিত। চালক, অর্থাৎ আত্মা এই দেহ-রূপ যানটিকে পরিত্যাগ করেছে বলেই এইসব যন্ত্রের কাজকর্ম সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে গেছে।
৩. চেতনা (Consciousness)
জীবন্ত দেহে রয়েছে চেতনা। ঠিক যেমন সূর্য তার চতুর্দিকে তাপ ও আলোকরশ্মি বিকিরণ করে, তেমনি আত্মাও সমগ্র দেহে চেতনা পরিব্যাপ্ত করে- পায়ের ডগা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত, সর্বত্র। দেহে পরিব্যাপ্ত এই চেতনাই আমাদেরকে চিন্তা, অনুভব বা চলাফেরা করতে সক্ষম করে। অতএব চেতনা হচ্ছে আত্মার লক্ষণ। চেতনার অস্তিত্বই একটি মৃত দেহের সঙ্গে জীবন্ত দেহের পার্থক্য সূচিত করে। এমন একটি যন্ত্র সহজেই তৈরী করা যেতে পারে, যেটির লেন্সে লাল আলো পড়া মাত্রই সেটি সাড়া দেয় ও তার থেকে এই তথ্য লেখা কাগজের টেপ বেরিয়ে আসেঃ “আমি লাল আলো দেখছি”, কিন্তু এই যান্ত্রিক সাড়া বা প্রক্রিয়ার মধ্যে কি সত্যি সত্যি কোনো অনুভবের স্পন্দন আছে, যা একটি চেতন জীব উপলব্ধি করে- যেমন কোনো মানুষের প্রভাতের রক্তিম সূর্যোদয় দেখে অনুভব করে? টমাস হাক্সলি যেমন যথার্থই বলেছেন, “এই বিশ্বে একটি তৃতীয় পদার্থ রয়েছে, অর্থাৎ চেতনা, যাকে আমি আদপেই কোনো জড় পদার্থ বা শক্তি বলে মনে করি না।” এই চেতনার অস্তিত্ব আত্মার অস্তিত্বকেই প্রমাণ করে।
৪। আসন্ন-মৃত্যুর অভিজ্ঞতা (N.D.E- Near Death Experience)
গবেষণায় সংগৃহীত তথ্যের দৃষ্টান্ত দ্বারা প্রদর্শিত হয় যে মন জড়ীয় মস্তিষ্ক ও দেহ হতে স্বতন্ত্র। এন.ডি.ই-র মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে দেহাতিরিক্ত অভিজ্ঞতা বা ও.বি.ই (আউট-অব-বডি এক্সপিরিয়েন্স), যেখানে বিভিন্ন মানুষ তাদের নিজেদের দেহ ও অন্যান্য দেহসংক্রান্ত ঘটনাবলীর কথা জানাচ্ছেন যা দেহাতীত কোন পটভূমিতে থেকে পর্যবেক্ষণ করা- তাদের গুরুতর অসুস্থতা, দৈহিক যন্ত্রণা বা অপারেশনের সময়, যখন তাদের দেহ থাকে অজ্ঞান বা ‘অচেতন’। এর আদর্শ দৃষ্টান্ত হচ্ছে, একজন হৃদরোগী শল্য চিকিৎসার পর কিঞ্চিৎ সুস্থ হয়ে অপারেশনকালীন সমস্ত ঘটনার আনুপূর্বিক বর্ণনা দিচ্ছেন, যেন বাইরে থেকে তিনি সেসব দেখেছেন। এইরকম অনুভবের সময় মেডিক্যাল অভিমত অনুসারে তার মস্তিষ্কের স্বাভবিক ক্রিয়াকলাপ বন্ধ হয়ে যায়- যন্ত্রে ব্রেন-ওয়েভের রেখাচিত্র বা গ্রাফের রেকর্ড থেকে তা স্পষ্ট বোঝা যায়, এবং ঐ রোগী তখন অজ্ঞান অবস্থায় থাকেন।
এন.ডি.ই নিয়ে পরিপূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত, নিখুঁত গবেষণা করে বহু ব্যক্তি তাদের রিসার্চ-রিপোর্ট উপস্থাপন করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, এমরি ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল স্কুলের প্রফেসর ও কার্ডিওলজিস্ট ডক্টর মাইকেল বি. স্যাবম্ প্রথমে এন.ডি.ই- সম্পর্কে ছিলেন অত্যন্ত সন্দিগ্ধ; কিন্তু ঐগুলির সত্যতা তদন্ত করে দেখার পর তিনি তাঁর মত পরিবর্তন করেন। কঠোর রিসার্চ-এর ভিত্তিতে ডক্টর স্যাবম্ লেখেন, “মানুষের মস্তিষ্ক যদি এই দুটি মৌলিক উপাদান দিয়ে নির্মিত হয়- ‘মন’ ও ‘মস্তিষ্ক’, তাহলে বহু মানুষের মৃত্যুকালীন অভিজ্ঞতার ঘটনা কি অত্যন্ত অস্থায়ী সময়ের জন্য হলেও মন ও মস্তিষ্কের বিচ্ছিন্নতাকেই প্রদর্শন করে না? এই দেহাতীত অভিজ্ঞতার জবানবন্দী আসলে প্রচলিত ধর্মীয় তথ্যের সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি সঙ্গগিপূর্ণ মনে হয়। সেই মন, যা শরীরস্থ মস্তিষ্ক হতে বিমুক্ত হয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে- সেটি কি আসলে মূলগতভাবে আত্মা হতে পারে, চরমে জড় শরীরের বিনাশের পরেও যার অস্তিত্ব থাকে অব্যাহত, ঠিক যেমন কিছু কিছু ধর্মীয় মতবাদে বলা হয়ে থাকে? আমার মনে হচ্ছে যে এই সব এন.ডি.ই-র রিপোর্টগুলি যে চরম প্রশ্নটিকে তুলে ধরেছে, এ হচ্ছে সেই প্রশ্ন।”
৫। পূর্বজন্মের স্মৃতি
বহু নিষ্ঠাবান গবেষক এই পূর্বজন্মের স্মৃতির উপর নিরপেক্ষ কঠোর ও নিয়মানুগভাবে বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার সাইক্রিয়াট্রির অধ্যাপক ইয়ান স্টিভেনসন শিশুদের দ্বারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথিত তাদের পূর্বজন্মের স্মৃতির উপর ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। শিশুদের দেওয়া তাদের পূর্ব জন্মের জন্মস্থান, তাদের পূর্ব নাম ও চেহারা, তাদের স্বজন-বর্গের ও অন্যান্য পরিচিতদের নাম পুনর্জন্মের সত্যতাকেই হুবহু সমর্থন করে। প্রফেসর স্টিভেনসন বহু সংখ্যক ঘটনার-বিবরণী একত্রিত করে সেগুলির সত্যতা যাচাইয়ে ব্রতী হন এবং সেই সাথে কোন প্রকার জালিয়াতি যাতে না হতে পারে সে ব্যাপারে তিনি কঠো সতর্কতা গ্রহণ করেন। তাঁর গবেষণা বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ উপস্থাপন করে যে চেতন আত্মা একটি জড় শরীর থেকে অপর একটি জড় শরীরে গমন করতে পারে, দেহান্তরিত হতে পারে। স্পষ্টতঃই, যখন একটি দেহের মৃত্যু হয় তখন তার মস্তিষ্কের কোষগুলি নষ্ট হয়ে যায়, এবং কোন রকম বাহ্যিক প্রক্রিয়ার সাহায্যেই সেগুলিকে আর অন্য আরেকটি মস্তিষ্কে প্রভাবিত করতে পারে না, সেইজন্য কখনই কোন মৃত মানুষের স্মৃতি কোনো শিশুর মস্তিষ্কে শারীরিকভাবে সঞ্চারিত হবার বা করবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। সেজন্য একটি শিশুর পূর্বজন্মের স্মৃতিচারণ এটিই প্রমাণ করে যে ঐ দেহস্থ ব্যক্তি আগের জন্মে ঐ পূর্বেকার দেহটি ব্যবহার করেছে, যার কিছু স্মৃতি সে অভিব্যক্ত করতে পারছে। অতএব সরলার্থ হচ্ছে এই যে চেতন আত্মা অবশ্যই এমন একটি সত্তা যা দেহস্থ মস্তিষ্ক থেকে পৃথক।
স্থুল দেহ ও সূক্ষ্ম দেহ
Fetus in the womb and Paramatma
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভগবদগীতায় বলেছেনঃ
অবিনাশী তু তদ্বিদ্ধি যেন সর্বং ইদং ততম্।
বিনাশং অবিনাশ্যস্য ন কিঞ্চিৎ কর্তুমর্হসি।।
“সমগ্র শরীরে পরিব্যাপ্ত রয়েছে যে অক্ষয় আত্মা, জেনে রেখো তাকে কেউ বিনাশ করতে সক্ষম নয়।” (ভ.গী.– ২/১৭)
ভগবদগীতা অনুসারে, আপনি এই দেহ নন। আপনি মন নন। আপনি বুদ্ধিও নন, আপনি মিথ্যা অহঙ্কারও নন। আপনি এই জড় দেহের সমস্ত জড় পদার্থের অতীত বস্তু। আপনি হচ্ছেন সেই চেতনা, সারা দেহে যা পরিব্যাপ্ত রয়েছে। আপনি হচ্ছেন চির অবিনাশী আত্মা। এরপর শ্রীকৃষ্ণ বলেন,
“ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ।
অহঙ্কারং ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা।।”
“ভূমি, জল, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি এবং অহঙ্কার- এই অষ্ট প্রকারে আমার ভিন্না জড়া প্রকৃতি বিভক্ত।” (ভ.গী. ৭/৪)
এই উপাদানগুলি সর্বদাই পরিবর্তনশীল। স্থূল শরীর তৈরী হয়েছে উপরোক্ত প্রথম পাঁচটি উপাদান দিয়েঃ ‘ভূমি’ বলতে বোঝায় সমস্ত কঠিন পদার্থকে। জল বলতে বোঝায় সমস্ত তরল পদার্থ। অগ্নি হচ্ছে আলোক ও তেজ (তাপ)। বায়ু হচ্ছে সমস্ত গ্যাসীয় পদার্থ। আকাশ হচ্ছে শূন্যস্থান (ইথার) এবং শব্দ। স্থূল দেহে এই পাঁচটি পদার্থ রয়েছে।
সূক্ষ্ম শরীর তিনটি সূক্ষ্ম উপাদান দ্বারা গঠিতঃ মন, বুদ্ধি ও মিথ্যা অহংকার (ভ্রান্ত ‘আমি’ বোধ)। প্রকৃত অহঙ্কার হচ্ছে এই উপলব্ধিঃ ‘আমি চিন্ময় আত্মা, কৃষ্ণের নিত্য দাস’। মিথ্যা অহঙ্কার হচ্ছে মোহগ্রস্ত অবস্থায় এই রকম চিন্তা করা, “আমি এই দেহ।” সূক্ষ্ম দেহ ও স্থূল দেহ হচ্ছে চেতনার উপর জড়ীয় আবরণ। এইরকম সূক্ষ্ম এবং স্থূল দেহে বদ্ধ একটি জীবাত্মাকে বলা হয় ‘বদ্ধ জীব’। যিনি এইরকম আবরণ থেকে মুক্ত এবং ভগবদ্ধাম প্রাপ্ত হন, তাঁকে বলা হয় মুক্তাত্মা। তারপর শ্রীকৃষ্ণ বলেন,
অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম্।
জীবভূতং মহাবাহো যয়েদং ধার্যতে জগৎ।।
“হে মহাবাহো ! এই নিকৃষ্টা প্রকৃতি ব্যতীত আমার আর একটি উৎকৃষ্টা প্রকৃতি রয়েছে। সেই প্রকৃতি চৈতন্য-স্বরূপা ও জীবভূতা; সেই শক্তি থেকে সমস্ত জীব নিঃসৃত হয়ে এই জড় জগৎকে ধারণ করে আছে।” (ভ.গী. ৭/৫)
ভগবানের শক্তিরাজি (God’s Energies)
অপরা (নিকৃষ্টা) জড়া শক্তি পরা (উৎকৃষ্টা, চিন্ময়)শক্তি
(Inferior Material Energy) (Superior Spiritula Energy)
স্থূল উপাদান সূক্ষ্ম উপাদান চিন্ময় দেহ (আত্মা)
(Gross Elements) (Subtle Elelments)
১. ভূমী (Earth) ১. মন (Mind) ১. সৎ (Eternal)
২. জল (Water) ২. বুদ্ধি (Intelligence) ২. চিৎ (Full of knowledge)
৩. অগ্নি(Fire) ৩. মিথ্যা অহঙ্কার (False Ego) ৩. আনন্দ (Full of Bliss)
৪. বায়ু (Air)
৫. আকাশ (Ether)
অনুৎকৃষ্টা অপরা শক্তি (জড় বস্তু) এবং উৎকৃষ্টা পরা শক্তি (আত্মা) উভয়ই পরমেশ্বর ভগবানের অধীন। আত্মাই হচ্ছে জীবন। শরীরটি সবসময়ই মৃত। ঠিক যেমন আপনি যদি হাতে দস্তানা পরেন এবং আঙুলগুলি সঞ্চালন করতে থাকেন, তাহলে দস্তানাকে জীবন্ত বলে মনে হতে পারে। ঠিক তেমনি আত্মা শরীরকে সঞ্চালন করে। শরীরটি সবসময়ই মৃত, এমনকি যখন আত্মা ঐ দেহের মধ্যে অবস্থান করতে থাকে তখনও দেহটি মৃত, কেননা শরীরটি কেবল কিছু মৃত অচেতন জড় পদার্থ দিয়ে তৈরী- মাটি, জল, আগুন, বাতাস, আকাশ এবং মন, বুদ্ধি ও মিথ্যা অহঙ্কার।
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
মানুষ কি কেবল একটি শক্তিশালী কম্পিউটার/ রোবট?
কম্পিউটারের হার্ডওয়ারটি কতকগুলি নির্দেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় (এই সব নির্দেশগুচ্ছের জন্য নানারকম ভাষাও রয়েছে, যেমন ফরট্রান, বেসিক, অথবা সি প্লাস প্লাস, ইত্যাদি)। এটি স্পষ্ট যে একটি কম্পিউটারকে কার্যক্ষম হওয়ার জন্য অবশ্যই একজন বুদ্ধিমান মানুষের দ্বারা নির্দেশিত (প্রোগ্রাম্ড্) হতে হয়। যে-ক্ষমতাই একটি কম্পিউটারের থাকুক না কেন, তা সে সংখ্যার কচকচি, তথা সংরক্ষণ, বস্তু সনাক্তকরণ, বা স্বাভাবিক ভাষার প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি যাই হোক না কেন- তার সমস্ত ক্রিয়াক্ষমতাই একজন সংবেদনশীল চেতন মানুষ-এর দ্বারা প্রদত্ত। অন্য কথায়, যদি কম্পিউটারের কার্যনির্দেশক বা প্রোগ্রামার কম্পিউটার-সিস্টেমকে দুই যোগ দুই = পাঁচ, এই অঙ্ক কষতে প্রোগ্রাম করে রাখে, তাহলে কম্পিউটার ঐরকমই করবে। ঠিক সেই রকম দেখার ক্যামেরা-ব্যবস্থার সংগে সংযুক্ত কোনো কম্পিউটারকে যদি কোনো ঘনকাকৃ্তি (স্কয়ার)বস্তুকে গোল বলে সনাক্ত করার প্রোগ্রাম করা থাকে, তাহলে সেটি তাই-ই করবে। কম্পিউটার নিজে থেকে কোনো কিছুই বুঝতে পারে না। প্রোগ্রাম করা না থাকলে শুধু কম্পিউটারটি কেবল একটি বোবা যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়।
উদাহরণস্বরূপ, একটি নাটকাভিনয়ের কথা মনে করুন। একদল বিচারকমণ্ডলী নাটকটি দেখছেন, আর একটি ভিডিও ক্যামেরার দ্বারা পুরো নাট্যাভিনয়টি রেকর্ড করা হচ্ছে। বিচারক অভিনীত ঘটনাবলীকে রেকর্ড করতে তাঁর চোখকে ব্যবহার করছেন, আর ভিডিও ক্যামেরাটি সমস্ত ঘটনাবলীকে রেকর্ড করছে লেন্সের মাধ্যমে, যা চোখেরই যান্ত্রিক রূপায়ণ বা মেশিন-এনালগ। ঐ দর্শন –যন্ত্র এবং মানুষ – উভয় পর্যবেক্ষক তথ্য-উপাত্ত রেকর্ড করছে, কিন্তু মানুষ-পর্যবেক্ষক পরিদৃশ্যমান ঘটনাবলীকে “উপলব্ধি”-ও করছে। দৃষ্টন্তস্বরূপ, বিচারকমণ্ডলী একটি আবেগময় নাটকের সমগ্র আবেগমথিত দৃশ্যাবলী প্রত্যক্ষ করলেন, তাঁরা নাটকে গর্ব, দুঃখ, প্রকাশিত হতে দেখলেন। অপরদিকে ভিডিও ক্যামেরাটি আবেগ-অনুভূতিহীনভাবে কেবল কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঞ্চালন ও শব্দাবলী রেকর্ড করল। নাটক সমাপ্ত হলে বিচারকমণ্ডলী তাঁদের চোখের সামনে দৃশ্যায়িত দৃশ্য-চিত্রের ভিত্তিতে সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনয়কারীকে নিরূপণ করলেন। কিন্তু ভিডিও ক্যামেরাটি কি ঐরকম কোন সিদ্ধান্ত দিতে সক্ষম- যদিও সে নাটকের প্রতিটি দৃশ্যই অভ্রান্তভাবে রেকর্ড করে রেখেছে?
পার্থক্যটি হচ্ছে এই যে, যদিও মানুষ ও ক্যামেরা – উভয় পর্যবেক্ষকই নাটকটি নিরীক্ষণ করছে, মানুষ হচ্ছে “চেতন”, কিন্তু ক্যামেরাটি সম্পূর্ণরূপে চেতনাহীন। সুতরাং মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যে প্রধান পার্থক্যটি হচ্ছে চেতনা- চেতনাগত পার্থক্য।
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
দেহ এবং আত্মার সম্বন্ধঃ দেহ একটি গাড়ীর মতো; আত্মা তার চালক
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
দেহকে একটি গাড়ীর সংগে তুলনা করা হয়, আত্মাকে তুলনা করা হয় চালকের সংগে। যদি একটি বোধশক্তিহীন কুকুরের ছানা রাস্তায় কোন একটি বড় গাড়ীকে আসতে দেখে, তাহলে সে এই ভেবে ভয় পেতে পারে যে ওটি একটি চার চাকার চলমান বড় কোন জন্তু। কিন্তু বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বুঝতে পারে যে ওটি জন্তু নয়- একটি মৃত ব্যক্তিত্বহীন গাড়ী যা একজন চেতন চালকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। গাড়ীতে রাস্তা দেখার জন্য হেডলাইট রয়েছে, ঠিক যেমন আপনি আপনার চোখের সাহায্যে দেখেন। গাড়ী হর্ণের সাহায্যে আওয়াজ করে, আপনি মুখের সাহায্যে। গাড়ীর চারটি চাকা রয়েছে, আপনার দেহটির দুটি হাত ও দুটি রয়েছে। গাড়ীটি এক জায়গা হতে অন্যত্র চলাফেরা করে, আপনিও সেটাই করেন। কিন্তু গাড়ীতি থেকে চালক নেমে যাওয়ার পর ঐ গাড়ীটি এমনকি দশ লক্ষ বছরেও এক ইঞ্চি চলতে পারে না। ঠিক তেমনি, যখন একজন মানুষ মারা যায়, শরীরটি তখন পুরোপুরিই ঐ চালক-বিহীন গাড়ীটির মতোই – নিশ্চল, অনড়। সুতরাং আমরা যে দেহটিকে দেখি তা সবসময়ই মৃত। আত্মার উপস্থিতির জন্যই দেহকে জীবন্ত বলে মনে হয়। আত্মা যখন দেহ ত্যাগ করে, তখন দেহটি সম্পূর্ণ চলচ্ছক্তিহীন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
একবার একজন বিজ্ঞানী একটি মৃতদেহ নিয়ে সেই দেহটির সমস্ত রাসায়নিক পদার্থকে পৃথক করে তার বাজার মূল্য যাচাই করে রিপোর্ট করে দিলেন যে ঐ দেহটির দাম দাঁড়াচ্ছে ১১০ টাকা (যদি সেটিকে বাজারে বিক্রী করা হয়)! তা, আপনি কি এমন মনে করেন যে আপনার মূল্য ১১০ টাকা? কিন্তু যখন একজন জীবিত ব্যক্তি তাঁর দেহের ছোট্ট একটি আঙুল হারায়, কিংবা তাঁর কিডনীটিকে বদলাতে হয়, তাহলে তিনি লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে থাকেন। জীবিত দেহের মধ্যে এমন কোন পদার্থ রয়েছে যা এই দেহকে এত মূল্যবান করে তোলে? আর একটি মৃতদেহে কি অনুপস্থিত যা ঐ দেহকে মূল্যহীন জঞ্জালে পরিণত করে? উত্তর হচ্ছেঃ আত্মা।
আত্মা (জীবনী শক্তি), উদ্ভিদ, পশুপাখী এবং মানুষ সকলের মধ্যেই রয়েছে। যেখানেই জীবন রয়েছে, সেখানে অবশ্যই আত্মা রয়েছে, কেননা আত্মাই হচ্ছে জীবন। অ্যামিবাই হোক, হাতি হোক, অথবা একটি মানুষ হোক- সব জীবিত দেহের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে আত্মা।
আধুনিক যুগঃ খাঁচা-পরিচর্যার সংস্কৃতি
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
শরীরকে একটি খাঁচার সংগেও তুলনা করা হয়, আর খাঁচার টিয়া পাখীকে তুলনা করা হয় শরীরস্থ আত্মার সংগে। ধরুন কেউ খাঁচায় এইভাবে একটি পাখী পুষে কেবল খাঁচাটিকে সুন্দরভাবে তদ্বির করছে – যেমন বিশেষ ডিজাইনের সুন্দর সোনার খাঁচায় পাখীটিকে রেখে প্রতিদিন খাঁচাটিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, খাঁচাটিকে ভালভাবে ঘষে-মেজে পালিশ করে ঝকঝকে করা ইত্যাদি। সকলে খাঁচাটিকে দেখে বিমুগ্ধ হয়ে প্রশংসা করে, এবং তাতে উৎসাহিত হয়ে সে আরো ভালভাবে খাচাটির যত্ন নিতে থাকে। কিন্তু এসব করতে গিয়ে সে পাখীটির কথা বেমালুম ভুলে যায়। পাখীটিকে দেয় না খাদ্য জল। ঠিক তেমনি, বর্তমান যুগে, আধুনিক সভ্যতায় প্রত্যেকে দেহের জন্য সমস্ত রকম আরাম স্বাচ্ছন্দ্য, বিলাসিতার ব্যবস্থা করার জন্য অত্যন্ত ব্যস্ত, কিন্তু আত্মার প্রয়োজনের দিকে কেউ দৃষ্টিপাত করছে না। সেজন্য প্রত্যেকেই পারমার্থিকভাবে ‘অনশনে’ ভুগছে। প্রত্যেকেই অন্ত্ররে বিষণ্ন, নিরানন্দ, এবং প্রত্যেকেই অজ্ঞান-তমসায় আবৃত হয়ে দুর্দশা ভোগ করছে। দেহ-খাঁচাটি যে অচিরেই ছাড়তে হবে, সে সম্বন্ধে অধিকাংশেরই কোনো জ্ঞান নেই, আর সে শিক্ষাও দেওয়া হচ্ছে না কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলে, বিশ্বজুড়ে এই দেহতদ্বিরের, খাঁচাটি-পালিশের গভীরতাহীন সংস্কৃতি গড়ে উঠছে।
আত্মা-সম্পর্কিত জ্ঞান
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
আত্মা অবিনশ্বর
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ । ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ ॥২৩॥ অর্থাৎ অনুবাদ:- আত্মাকে অস্ত্রের দ্বারা কাটা যায় না, আগুনে পোড়ান যায় না, জলে ভেজানো যায় না, অথবা হাওয়াতে শুকানোও যায় না।” ভ. গী. ২/২৩
আত্মা একজন ব্যক্তি
প্রত্যেক আত্মাই পৃথক পৃথক চেতনা-সমন্বিত এক একজন ব্যক্তি। আপনি আপনার দেহ, মন, বুদ্ধি ও মিথ্যা অহঙ্কার সম্বন্ধে সচেতন। আপনার মাথাব্যথা আমি অনুভব করতে পারি না, আবার আমি কি চিন্তা করছি আপনি তা জানেন না। কিন্তু ভগবান সৃষ্টির প্রত্যেকটি কণিকা সম্বন্ধে সচেতন; ন ত্বেবাহং জাতু নাসং ন ত্বং নেমে জনাধিপাঃ। ন চৈব ন ভবিষ্যামঃ সর্বে বয়মতঃপরম্ ॥১২॥ “এমন কোন সময় ছিল না যখন আমি, তুমি ও এই সমস্ত রাজারা ছিলেন না এবং ভবিষ্যতেও কখনও আমাদের অস্তিত্ব বিনষ্ট হবে না । ” (ভ. গী. ২/১২) মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ। মনঃষষ্ঠানীন্দ্রিয়াণি প্রকৃতিস্থানি কর্ষতি ॥৭॥ ‘এই জড় জগতে বদ্ধ জীবসমূহ আমার সনাতন বিভিন্নাংশ। জড়া প্রকৃতির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ফলে তারা মন সহ ছয়টি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রকৃতিরূপ ক্ষেত্রে কঠোর সংগ্র্রাম করছে।’ (ভ. গী. ১৫/৭)
3497_1
আত্মার রূপ আছে
আত্মা ‘নিরাকার নির্গুণ জ্যোতি’ বা ‘শূন্য’ কিছু মানুষ যেমন ভুল করে ভেবে থাকেন। আত্মা হচ্ছে এক সুন্দর ব্যক্তিত্ব, যার দেহ সৎ-চিৎ-আনন্দময়। আত্মা কেবল শক্তি মাত্র নয়, আত্মা একজন পূর্ণচেতন ব্যক্তি।
আত্মা শাশ্বত
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেনঃ ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্ নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ । অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ॥২০॥ “আত্মার কখনও জন্ম হয় না বা মৃত্যু হয় না, অথবা পুনঃ পুনঃ তাঁর উৎপত্তি বা বৃদ্ধি হয় না৷ তিনি জন্মরহিত শাশ্বত, নিত্য এবং পুরাতন হলেও চিরনবীন। শরীর নষ্ট হলেও আত্মা কখনও বিনষ্ট হয় না।” (ভ. গী. ২/২০)।
আত্মার একটি শরীর রয়েছে, যা সৎ (নিত্য, শাশ্বত), চিৎ (জ্ঞান), আনন্দময়
আত্মা এই জড়জগতে এসেছে ভগবৎ-ধাম থেকে, আর এজন্য ভগবদ্ধামে ভগবানের সংগে প্রত্যক্ষভাবে সম্বন্ধিত হবার উপযোগী আত্মার একটি শাশ্বত, জ্ঞানময় ও আনন্দময় শরীর রয়েছে, যা অ-জড়, চিন্ময় – অর্থাৎ পূর্ণচেতন। কিন্তু আত্মা যখন একজন স্বাধীন ভোক্তা হতে আকাঙ্খা করে, তখন তাকে জড় জগতে প্রেরণ করা হয়, যেখানে তাকে একটি জড় শরীরে আবদ্ধ হতে হয়। এটা হচ্ছে ঠিক একটি টিয়া পাখীর (আত্মা) খাঁচায় (জড় দেহে) আবদ্ধ হওয়ার মতো। কেন আমরা দুর্দশা ভোগ করি? কারণ সচ্চিদানন্দময় আত্মা এমন একটি দেহে আবদ্ধ হয়েছে যা অসৎ-আচিৎ-নিরানন্দ, সুতরাং চিদরূপময় আত্মার ক্ষণস্থায়ী জরা-ব্যাধিগ্রস্ত জড়শরীরে অবস্থান অত্যন্ত অসামঞ্জস্যপূর্ণ। আর সেজন্যই আমাদের দুঃখ ভোগ করতে হয়- আমাদের যাবতীয় দুর্দশার এটিই মূল কারণ।
আত্মার অবস্থান হৃদয়-প্রদেশে
আত্মা সারা দেহকে চেতনা দ্বারা পরিব্যাপ্ত করে, ঠিক যেমন একটি বাতি সারা ঘরকে আলোয় ভরে দেয়। সারা ঘরকে যে বাতিটি আলোকোজ্জ্বল করে তুলছে, সেই বাতিটি ঘরের একটি কোণে থাকতে পারে। ঠিক তেমনি আত্মা হৃদয়-প্রদেশে (হৃৎ-পিণ্ডে) অবস্থান করেও সারা দেহে চেতনা পরিব্যাপ্ত করে। হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের সময় আত্মাকে দেহ থেকে সরানো যায় না, কেননা আত্মা চিন্ময় (অ-জড়)। দৃষ্টান্তস্বরূপ, যখন একটি গাড়ী থেকে স্টেপনী কিংবা রেডিয়েটর সরিয়ে নেওয়া হয়, তখন ঐ গাড়ীতে বসে থাকা চালকের কিছুই হয় না। ঠিক তেমনি একটি -হৃৎপিণ্ড (যে কেবল রেডিয়েটরের মতো একটি রক্ত-সঞ্চালনকারি যন্ত্র) অন্য আরেকটি দ্বারা প্রতিস্থাপন করলেও শরীরস্থ আত্মা তাতে প্রভাবিত হয় না।
আত্মা দেহ-পরিবর্তন করে
‘বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্ণাতি নরোহপরাণি । তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্য- ন্যানি সংযাতি নবানি দেহী ॥২২॥’ “মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে, দেহীও তেমনই জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে নতুন দেহ ধারণ করেন। ” (ভ. গী.- ২/২২)। ‘দেহিনোহস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা ।তথা দেহান্তরপ্রাপ্তির্ধীরস্তত্র ন মুহ্যতি ॥১৩॥’ “দেহীর দেহ যেভাবে কৌমার, যৌবন ও জরার মাধ্যমে তার রূপ পরিবর্তন করে চলে, মৃত্যুকালে তেমনই ঐ দেহী ( আত্মা ) এক দেহ থেকে অন্য কোন দেহে দেহান্তরিত হয়। স্থিতপ্রজ্ঞ পণ্ডিতেরা কখনও এই পরিবর্তনে মুহ্যমান হন না ।” (ভ. গী.- ২/১৩)
আত্মার আয়তন
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে এবং শ্রীমদ্ভাগবতে বীজ-রূপে জড়দেহে বিরাজিত আত্মার আয়তন বর্ণিত হয়েছে। যেমন শ্বেতাশ্বতর উপ-৫/৮-এ বলা হয়েছে, ‘বালাগ্র শতভাগস্য শতধা কল্পিতস্য চ। ভাগো জীবঃ স বিজ্ঞেয়ঃ স চানন্ত্যায় কল্পতে।।’ ‘কেশাগ্রকে শতভাগে ভাগ করলে তার যে আয়তন হয়, আত্মার আয়তনও ততখানি।’ এই হচ্ছে আত্মার বীজ-রূপী আয়তন। আত্মা জড়-ব্রহ্মাণ্ডে নানা শরীরে ভ্রমণকালে তার এই আয়তন থাকে। কিন্তু চিন্ময় জগতে ভগবদ্ধামে আত্মার একটি আদি, অপরূপ-সুন্দর সচ্চিদানন্দময় অর্থাৎ নিত্য, আনন্দময় ও জ্ঞানময় দেহ রয়েছে, যাকে বলা হয় আত্মার ‘স্বরূপ’ (আত্মার আদি নিত্য-সনাতন স্বরূপদেহ); পক্ষান্তরে জড় জগতে বদ্ধাবস্থায় আত্মার জড় শরীরকে বলা হয় বিরূপ বা বিকৃ্ত জড় রূপ)। তার নিত্য চিন্ময় স্বরূপে প্রত্যেক আত্মার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সংগে নিম্নোক্ত পাঁচটি রসের যেকোন একটিতে এক শাশ্বত মধুর সম্পর্ক রয়েছেঃ শান্ত রস, দাস্য রস, সখ্য রস, বাৎসল্য রস এবং মাধুর্য (দাম্পত্য) রস।
আত্মা অচিন্ত্য
চুলের অগ্রভাগের দশ হাজার ভাগের এক ভাগ এতই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যে এমনকি বর্তমানের সবচেয়ে শক্তিশালী ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপেও তা দেখা অসম্ভব। কিন্তু আমরা যদি এমনকি এই ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপের থেকেও অনেক শক্তিশালী কোনো অনুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কারেও সক্ষম হই, এবং তার মধ্য দিয়ে আত্মাকে দেখার চেষ্টা করি, তবুও আমাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। আমরা এমনকি আমাদের চিন্তাকেও দর্শন করতে পারি না, তা পরিমাপ করতে পারি না। এমনকি মনও- যা হচ্ছে জড়ের সূক্ষ্ম রূপ- আমাদের কাছে অদৃশ্য, দৃষ্টির অগোচর, অব্যক্ত। সংজ্ঞানুযায়ী আত্মা মনেরও অতীত। এটি কেবল অব্যক্তই নয়, আত্মা আচিন্ত্য, অচিন্তনীয়। আপনি এমনকি এর- চিন্তাও করতে পারেন নাঃ অব্যক্তোহয়মচিন্ত্যোহয়মবিকার্যোহয়মুচ্যতে । তস্মাদেবং বিদিত্বৈনং নানুশোচিতুমর্হসি ॥২৫॥, “এই আত্মা অব্যক্ত, অচিন্ত্য ও অবিকারী বলে শাস্ত্রে উক্ত হয়েছে। অতএব এই সনাতন স্বরূপ অবগত হয়ে দেহের জন্য তোমার শোক করা উচিত নয় ।” (ভ. গী. – ২/২৫)।
দেহ ও আত্মার পার্থক্য
দেহ (Body) আত্মা (Soul)
১. অচেতন(Unconscious) ১. চেতন(Conscious), দেহে পরিব্যাপ্ত চেতনার উৎস;
২. জড়, আট রকম জড় উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত; ২.জড় উপাদানশূন্য, চিন্ময়, চিৎকণা
(তিন রকম চিদ্বিভাবের অভিভাজ্য রূপ)
৩.সদা পরিবর্তনশীল; প্রতিদিনই দেহের রূপান্তর হয় ৩.চির অ-পরিবর্তনীয়, অব্যয়; ‘অবিকারী’,
(বৃদ্ধি-ক্ষয় প্রভৃতি ৬টি পরিবর্তনের অধীন) বৃদ্ধি-ক্ষয় প্রভৃতি পরিবর্তনহীন;
৪. নশ্বর, বিনাশশীল, অনিত্য; ৪. অবিনশ্বর, নিত্য, শাশ্বত;
৫.ভগবানের বহিরঙ্গা, অপরা জড়া প্রকৃ্তির সৃষ্টি; ৫.ভগবানের অবিচ্ছেদ্য-অংশ,
তটস্থা শক্তি, পরা প্রকৃ্তি-সম্ভূত;
৬. স্থূল, পরিমাপযোগ্য; ৬. সূক্ষ্ম, অপরিমেয়;
৭. ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভবযোগ্য; ৭. জড় ইন্দ্রিয়ের অগোচর;
৮. অস্ত্রাদির দ্বারা বিনাশযোগ্য; ৮. অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য, অশোষ্য;
৯. অজ্ঞান বস্তুপিণ্ড; ৯. জ্ঞানময়; সকল গুণাবলীর আধার;
১০. ব্যক্তিত্বহীন যন্ত্র; ১০. মূল ব্যক্তি, ব্যক্তিত্বের কেন্দ্র;
১১. দুঃখ-ক্লেশের আধার নিরানন্দময়; ১১. আনন্দময়;
১২. পরিচালিত যন্ত্র (Car, Instrument); ১২. পরিচালক (Driver, user);
১৩. অনুভব- সামর্থ্যহীন; ১৩. অনুভূতিশীল; অনুভবের কেন্দ্র;
১৪. ইচ্ছা-দ্বেষ-বাসনা-সক্রিয়তা শূন্য; ১৪. ইচ্ছা-দ্বেষ-মান-অভিমান-বাসনা-সক্রিয়তা যুক্ত;
১৫. মিথ্যা অহঙ্কার নামক সূক্ষ্ম উপাদান সমন্বিত; ১৫. মিথ্যা অহঙ্কার বিহীন; প্রকৃ্ত আমি
(Real person);
১৬. জড় ইন্দ্রিয়যুক্ত; ১৬. চিন্ময় ইন্দ্রিয়যুক্ত;
১৭. মন, বুদ্ধি জড়; ১৭. মন, বুদ্ধি চিন্ময়;
১৮. অস্থায়ী পোশাক, ‘বিরূপ’। ১৮. শাশ্বত ব্যক্তি, ‘স্বরূপ’।
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
আমি কি ভগবান?
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
ভারতবর্ষে বর্তমানে অদ্বৈতবাদ, অর্থাৎ “আমি ভগবান। তুমি ভগবান। প্রত্যেকেই ভগবান” – এই দর্শন খুবই প্রচলিত। এই ধরণের দর্শন সেই সব বদ্ধ জীবাত্মাদের অন্তরে অসীম সন্তোষ প্রদান করে থাকে, যাদের ভোক্তা ও নিয়ন্তা হবার বাসনা প্রবল। বদ্ধ জীবাত্মা এমন ভোক্তা ও নিয়ন্তা হতে চায়। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এমন কেউ কি আছে যে নিয়ন্ত্রণাধীন, নিয়ন্ত্রিত নয়? সংজ্ঞানুসারে ভগবান পরম স্বরাট্, স্বাধীন স্বতন্ত্র পুরুষ এবং তিনি কারো নিয়ন্ত্রণাধীন নন। তিনিই পরম নিয়ন্তা। জীব অবিনাশী, শাশ্বত, অব্যক্ত এবং অচিন্ত্য, কিন্তু তবুও সে কি ভগবান হতে পারে? এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর আপনার পারমার্থিক জীবনের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
ভগবদগীতা এ-বিষয়ে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে জীব কখনো ভগবান নয়, কখনো সে ভগবান হতেও পারবে না; সমস্ত জীবসত্তা ও ভগবান নিত্য স্বতন্ত্র, যদিও উভয়ে চিন্ময়, সেজন্য গুণগতভাবে উভয়েই এক। জীব ক্ষুদ্রচিদ্ অণু, তাই সূর্যের কিরণকণা যেমন সূর্যের মতো ধর্ম বিশিষ্ট হলেও স্বয়ং সূর্য নয়, তেমনি চিৎ-কণাজীব ভগবানের মতো চিদ্ধর্ম বিশিষ্ট হলেও পরিমাণগতভাবে অত্যন্ত ক্ষুদ্র। ভগবদগীতায় এটাও দ্বার্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে যে এমনকি মোক্ষ বা মুক্তিলাভের পরও জীব আত্মস্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ভগবানে একীভূত হয়ে যায় না; প্রত্যেকের ব্যক্তিত্বই শাশ্বত। ভগবদগীতায় বলা হয়েছে (১৫/১৬)ঃ
দ্বাবিমৌ পুরুষৌ লোকে ক্ষরশ্চাক্ষর এব চ। ক্ষরঃ সর্বাণি ভূতানি কুটস্থোহক্ষর উচ্যতে।। “ক্ষর এবং অক্ষর দুই প্রকার জীব রয়েছে। এই জড় জগতে প্রতিটি জীবই ক্ষর এবং চিজ্জগতে প্রতিটি জীবই অক্ষর।”
এই জগতে আমরা যারা আমাদের শাশ্বত চিন্ময় স্বরূপ সম্বন্ধে অসচেতন, তারা ক্ষর (পরিবর্তনশীল দেহ-সম্পন্ন জীব)। এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রথম সৃষ্ট জীব ব্রহ্মা থেকে শুরু করে নগণ্য একটি পিঁপড়ে পর্যন্ত যে জীব-সত্তাই জড়ের সংস্পর্শে এসেছে, জড়-পদার্থের আবরণে তৈরী দেহাবয়ব ধারণ করেছে, সে ক্ষর। কিন্তু চিন্ময় জগতে দেহটি জড় পদার্থের তৈরী নয়, সেজন্য সেই দেহে কোনো পরিবর্তন হয় না; ঐ চিদ্-দেহ চির-শাশ্বত, অপরিবর্তনীয়। ঐ দেহে কখনো জরা-ব্যাধি-বার্ধক্য আসে না, সেই দেহের জন্ম-মৃত্যুও নেই। যে সব জীবসত্তা চিন্ময় জগতে পরম পুরুষ ভগবানের সংগে আনন্দবিলাসরত, তাঁরা সকলেই অক্ষর (অপরিবর্তনীয়), তাঁরা অনন্তকালের জন্য অপরিবর্তনীয় শাশ্বত আনন্দময় স্বরূপ-বিশিষ্ট।
উত্তম পুরুষস্ত্বন্যঃ পরমাত্মেত্যুদাহৃঢ়ঃ।।
যো লোকত্রয়মাবিশ্য বিভর্ত্যব্যয় ঈশ্বরঃ।।
“এই উভয় পুরুষ থেকে ভিন্ন, পুরুষোত্তম, পরমাত্মা রূপে সমগ্র বিশ্বে প্রবেশ করে তাদের পালন করেন” (ভ. গী. ১৫/১৭)। এখানে এটা অত্যন্ত সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে অগণিত জীবসত্তা-সমূহের মধ্যে কিছু জীব বদ্ধ, এবং অন্য সমস্ত জীব মুক্ত; এবং এই বদ্ধ ও মুক্ত (ক্ষর ও অক্ষর) উভয় জীবসত্তার মধ্যে পরম পুরুষোত্তম হচ্ছেন পরমাত্মা, ভগবান।
ভগবানের সংজ্ঞা:-
ভগবানের একটি সরল সংজ্ঞা হচ্ছে : 'জন্মাদাস্য য্তঃ' - "যাঁর থেকে সমস্ত প্রকাশিত হয়" (ভা: 1/1/1)৷ 'ভগবান' শব্দটি সংস্কৃত, এবং এর অর্থ বিশ্লেষণ করেছেন ব্যাসদেবের পিতা পরাশর মুনি- "(১) সমগ্র ঐশ্বর্য (ধনসম্পদ), (২) সমগ্র বীর্য (শক্তিমত্তা), (৩) সমগ্র য্শ, (৪) সমগ্র শ্রী (সৌন্দর্য, রূপবত্তা), (৫) সমগ্র জ্ঞান ও (৬) সমগ্র বৈরাগ্য যাঁর মধ্যে পূর্ণ-রূপে বর্তমান, সেই পরম পুরুষ হচ্ছেন ভগবান ৷" 'ভগ' শব্দের অর্থ ছয়টি ঐশ্বর্য (ষড়ৈশ্বর্য ) এবং 'বান' শব্দের অর্থ যুক্ত বা সমন্বিত৷ যেমন জ্ঞানবান অর্থ জ্ঞান-সমন্বিত, ধনবান শব্দের অর্থ ধন-সমন্বিত, তেমনি ভগবান শব্দের অর্থ যিনি সম্পূর্ণভাবে ৬টি ঐশ্বর্য সমন্বিত৷ ঐ সমস্ত ঐশ্বর্য অন্যকে আকর্ষণ করে- আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হবার এটিই রহস্য৷ কারও যে-পরিমাণে এই ঐশ্বর্য থাকে, তিনি ততটাই আকর্ষণীয় হন৷ এজগতে সকলেরই ঐসব ঐশ্বর্য কিছু কিছু পরিমাণে রয়েছে- কিন্তু কেউই সমগ্র ঐশ্বর্য-সম্পন্ন নয়৷ অনেক ব্যক্তি রয়েছেন যাঁরা অত্যন্ত ধনবান, খুব বলবান, খুব রূপবান, অত্যন্ত য্শস্বী, খুব জ্ঞানী এবং অত্যন্ত বৈরাগ্যবান, কিন্তু কেউই দাবী করতে পারে না যে তাঁর সমগ্র ধনৈশ্বর্য , সমগ্র বলবত্তা, সমগ্র সৌন্দর্য ইত্যাদি রয়েছে- একমাত্র ভগবানেরই এগুলি পূর্ণমাত্রায় রয়েছে৷ উপরোক্ত ছয়টি ঐশ্বর্য যাঁর পূর্ণ মাত্রায় আছে, তিনি নিশ্চয়ই 'সর্বাকর্ষক'৷ সংস্কৃত ভাষায় সর্বাকর্ষক শব্দের সমতুল শব্দ হচ্ছে 'কৃষ্ণ'৷
এইভাবে আমরা দেখতে পাই যে, শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র পুরুষ, যিনি শাশ্বত কাল ধরে, সম্পূর্ণভাবে সমস্ত ঐশ্বর্যের অধিকারী ৷ শ্রীকৃষ্ণই পূর্ণ ঐশ্বর্যসম্পন্ন পরমপুরুষ, পরমেশ্বর ভগবান৷ পূর্ণ মাত্রায় ঐশ্বর্য সমূহের অধিকারী হওয়ায় শ্রীকৃষ্ণ পরম আকর্ষক, তিনি সর্বাকর্ষক পরম পুরুষ, সেজন্যই তাঁর নাম 'কৃষ্ণ', যিনি সকলকে আকর্ষণ-পূর্বক আনন্দ প্রদান করেন৷
সংক্ষেপে ভগবান ও জীবের পার্থক্য
অতএব, সংক্ষেপে আমাদের উপলব্ধি করা উচিতঃ
***আমরা জীবাত্মা; ভগবান হচ্ছেন পরমাত্মা;
***আমরা অণূ (ক্ষুদ্র চিৎ-কণ); ভগবান বিভু (অসীম);
***আমরা কেবল আমাদের নিজ দেহটি সম্বন্ধে সচেতন, অবগত; ভগবান প্রত্যেকের সম্বন্ধে এবং সমস্তকিছু সম্বন্ধে অবগত;
***আমরা নিত্যকালের জন্য পরমেশ্বর ভগবানের প্রেমময় সেবক, দাস, আর ভগবান হচ্ছেন আমাদের প্রেমময় প্রভু;
***আমরা গুণগতভাবে ভগবানের সংগে অভেদ, কিন্তু পরিমাণগতভাবে আমরা ভগবান হতে ভিন্ন। এই বাস্তব সত্যকে স্বীকার করে নেওয়ার উপর আমাদের জীবনের পরম সার্থকতা লাভ নির্ভর করে।
পরমাত্মাঃ জীবাত্মার বন্ধু
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
যখন জীবাত্মা এই জড় জগতে পতিত হয়, তখন তাকে নানা দেহে দেহান্তরিত করা, তার তত্ত্বাবধান করা এবং তাকে পথনির্দেশ দানের জন্য পরমপুরুষ ভগবানের এক প্রকাশ জীবাত্মার সঙ্গী হন। শ্রীকৃষ্ণের এই প্রকাশ প্রতিটি জীবের হৃদয়ে বিরাজ করেন- ঈশ্বর সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেঃ অর্জুন তিষ্ঠতি- ভ. গী. ১৮/৬১), এবং প্রত্যেক পরমাণুর মধ্যেও তিনি প্রবেশ করেন (পরমাণুচয়ান্তরস্থং, ব্রহ্মসংহিতা – ৩৫)। তাঁকে বলা হয় পরমাত্মা।
দুই প্রকারের আত্মা রয়েছেঃ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র চিৎ-কণ (অণু-আত্মা, জীবাত্মা), এবং পরম আত্মা (বিভু-আত্মা, পরমাত্মা)। জীবাত্মার অর্থ একটি স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা, পরমাত্মার অর্থ একজন পরম ব্যক্তিসত্তা। জীবাত্মা ও পরমাত্মা উভয়েরই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব রয়েছে, উভয়েই ব্যক্তিত্ব সমন্বিত। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য এই যে, জীবাত্মা কেবল একটি বিশেষ দেহে আবদ্ধ, পক্ষান্তরে পরমাত্মা সর্বত্র বিরাজমান। কঠোপনিষদেও একথা সমর্থিত হয়েছেঃ
অণোরণীয়ান্মহতো মহীয়ান্
আত্মাস্য জন্তোর্নিহিত গুহায়াম্।
তমক্রতুঃ পশ্যতি বীতশোকো
ধাতুঃ প্রসাদন্মহিমানমাত্মনঃ।।
“পরমাত্মা এবং জীবাত্মা উভয়েই বৃক্ষসদৃশ জীবদেহের হৃদয়ে অবস্থিত। যিনি সব রকম জড় বাসনা এবং সব রকমের শোক থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন, তিনিই কেবল ভগবানের কৃপার ফলে আত্মার মহিমা উপলব্ধি করতে পারেন।”
পরমাত্মার কৃপার ফলেই অণু আত্মা ভিন্ন ভিন্ন দেহ প্রাপ্ত হয়। বন্ধু যেমন বন্ধুর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে, পরমাত্মাও তেমনি অণু আত্মার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। মুণ্ডকোপনিষদ্ ও শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদে আত্মা এবং পরমাত্মাকে একই গাছে বসে থাকা দুটি পাখির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একটি পাখী (জীবাত্মা) সেই গাছের ফল ভক্ষণ করছে, অপর পাখীটি (শ্রীকৃষ্ণ) তাঁর বন্ধুকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। এই দুটি পাখী গুণগতভাবে যদিও এক, (উভয়েই সচ্চিদানন্দময়, অ-জড়), তবুও তাদের একজন (জীবাত্মা) সেই জড়জগৎ-রূপ গাছের ফলের আকর্ষণে আবদ্ধ। কখনো সে তিক্ত ফল আস্বাদন করে শোক করছে, কখনো বা সে মিষ্টি ফল খেয়ে আনন্দ করছে। পক্ষান্তরে অন্যজন তার সখাটির কার্যকলাপ কেবল পর্যবেক্ষণ করে চলেছে।
অর্জুন হচ্ছেন ফল-আহারে রত পাখী, আর পর্যবেক্ষণরত পাখীটি হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। যদিও তাঁরা একে অপরের বন্ধু, তবুও তাঁদের একজন হচ্ছেন প্রভু এবং অন্যজন হচ্ছেন ভৃত্য। পরমাত্মার সঙ্গে তাঁর এই সম্পর্কের কথা ভুলে যাবার ফলেই জীবাত্মা-রূপ পাখী এক গাছ থেকে অন্য গাছে, অর্থাৎ এক দেহ থেকে আরেক দেহে ঘুরে বেড়ায়। এই জড়দেহ-রূপ বৃক্ষে জীবাত্মা তার কর্মের ফল-স্বরূপ নানা রকম দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে, কিন্তু যে মুহূর্তে সে পরমাত্মার নিত্য দাসত্ব বরণ করে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করে- সেই মুহূর্তে সে জড়বন্ধন থেকে মুক্ত হয় এবং তার সবরকম দুঃখ-কষ্টের নিবৃত্তি ঘটে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে অর্জুনের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আমরা এই তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারি। কঠোপনিষদ এবং শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে আছে-
সমানে বৃক্ষে পুরুষো নিমগ্নোহনীশয়া শোচতি মুহ্যমানঃ।
জুষ্টং যদা পশ্যত্যন্যমীশমস্য মহিমানমিতি বীতশোকঃ।।
“দুটি পাখী একই গাছে বসে, কিন্তু যে পাখীটি ফল আহারে রত, সে তাঁর কর্মের ফলস্বরূপ সর্বদাই শোক, আশঙ্কা এবং উদ্বেগের দ্বারা মুহ্যমান। কিন্তু যদি সে একবার তার নিত্যকালের বন্ধু অপর পাখীটির দিকে ফিরে তাকায়, তবে তার সমস্ত শোকের অবসান হয়, কারণ তার বন্ধু হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান এবং তিনি সমগ্র ঐশ্বর্যের দ্বারা মহিমান্বিত।”
পদ্মপূরাণ থেকে আমরা জানতে পারি যে এই ব্রহ্মাণ্ডে মোট ৮৪ লক্ষ ধরণের জীব-শরীর বা প্রজাতি রয়েছে এদের মধ্যে ৯ লক্ষ প্রজাতি হচ্ছে জলচর জীব, ২০ লক্ষ উদ্ভিদ প্রজাতি, কীট-পতঙ্গ হচ্ছে ১১ লক্ষ প্রজাতির, পাখী-প্রজাতি হচ্ছে ১০ লক্ষ, পশু ৩০ লক্ষ প্রজাতির, এবং মানুষ ৪ লক্ষ প্রজাতির। জীবসত্তা নানা প্রজাতির বিভিন্ন রকম জীব-শরীরে অবিরাম দেহান্তরিত হয়ে চলে, কিন্তু পরমাত্মা একান্ত সখার মতোই সর্বদাই তার সঙ্গে থাকেন; সেই জীবসত্তা মানবদেহে বা একটি কীট দেহে- যে দেহেই অবস্থান করুক না কেন, ভগবান সর্বক্ষণ তার সঙ্গে থাকেন।
পুনর্জন্ম কি?
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
জড় বস্তু ও চেতন পদার্থের স্বরূপ সম্বন্ধে শাস্ত্র আমাদেরকে তথ্য প্রদান করে। প্রথম যে মৌলিক জ্ঞান আমাদের শিক্ষা দেওয়া হয়, তা হচ্ছে এই যে, আমরা এই জড়দেহগুলি নই, আমরা চেতন আত্মা। আত্মার শরীর সচ্চিদানন্দময়, জড়-উপাদান-বিহীন; তাঁকে বলা হয় স্বরূপ দেহ। পরিবর্তনশীল জড় দেহটি জড় পদার্থের নির্মিত। প্রকৃ্তপক্ষে, জড় শরীরের দুটি ভাগ রয়েছে স্থূল ও সূক্ষ্ম। মাটি (কঠিন পদার্থ), জল (তরল), অগ্নি (তাপ), বায়ু (গ্যাসীয়) এবং আকাশ, এই পাঁচটি উপাদানে তৈরী হয় স্থূল শরীর। মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার – এই তিনটি উপাদানে তৈরী হয় সূক্ষ্ম শরীর। এই দুটি শরীরই আত্মার জড় আবরণ বিশেষ। স্বরূপতঃ প্রতিটি জীবসত্তাই চিন্ময়, অজড় (সচ্চিদানন্দময়), কিন্তু যখন কোন জীব জড়জগৎকে উপভোগ করার বাসনা করে, তখন সে চিন্ময় জগৎ হতে জড় জগতে অধঃপতিত হয়। এভাবে যখন আত্মাকে জড় জগতে প্রেরণ করা হয়, তখন জড়জগতে তাকে জড় শরীরের আবরণে আচ্ছাদিত করা হয়, যাতে সে এই জড় পরিবেশের সংগে সামঞ্জস্যবিধান করে চলতে পারে, জড়জগতে বাস করতে পারে। ঠিক যেমন আপনি যখন বিদেশে যান, তখন সেই ঠান্ডা দেশের উপযোগী শীত বস্ত্র নিয়ে যান। জীবাত্মাকে প্রথমে মানব বা উচ্চতর কোনো প্রজাতির জন্ম দেওয়া হয়; কিন্তু সে যখন তার অপরাধ প্রবণতা সংশোধন না করে অধিকতর জড়-বিষয় সম্ভোগে আকাঙ্ক্ষিত হয়, তখন তাঁকে নিম্নতর প্রজাতিতে অধঃপতিত হতে হয়। তাঁর বিবর্তনের ধারায় ৮৪ লক্ষ প্রজাতির জীব শরীর- জলচর, উদ্ভিদ, পশু প্রভৃতি নানা জীব-শরীরে দেহধারণ করার পর তার মূল্যবান মানব-জন্ম লাভ হয়। তাকে বার বার দেহান্তরিত হওয়ার এই অন্তহীন চক্র হতে মুক্ত হবার আরেকটি সুযোগ প্রদান করা হয়। যে সরল প্রক্রিয়ায় জীব এক দেহ হতে অপর দেহে স্থানান্তরিত হয়, তাকে পূনর্জন্ম বলা হয়।
বাংলাতেই সংগৃহীত পুনর্জন্মের এক বাস্তব কেস-হিস্ট্রিঃ
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
ডঃ স্টিভেনসন-এর সংগৃহিত ২০০০ কেস-হিস্ট্রির একটি হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের একটি ছোট্ট মেয়ে। শুক্লার বয়স যখন মাত্র দেড় বছর, কথা বলতে শিখেছে কি শেখেনি, তখন থেকেই সে একটি বালিশ নিয়ে দোলনায় দোল দিত, আর বলত যে এটি হচ্ছে ‘মিনু’। সে বলত সে মিনু হচ্ছে তাঁর মেয়ে। পরবর্তী তিন বছরে শুক্লা তার পূর্ব জন্মের অনেক ঘটনাই স্মরণ করতে পারল, যাতে বোঝা গেল যে মিনু সত্যিই গত জন্মে তাঁর মেয়ে ছিল।
শুক্লা ছিল পশ্চিমবঙ্গের কম্পা গ্রামের এক রেলকর্মীর মেয়ে। সে কেবল তার মেয়ে মিনুর কথাই বলত না, ‘মিনুর বাবা’, অর্থাৎ তার স্বামী কথাও বলত, (অবশ্য তার নাম সে বলেনি- হিন্দু স্ত্রী তাঁর স্বামীর নামোচ্চারণ করে না)। সে তার গত জন্মের দুট
...

সোমবার, ২৭ জুলাই, ২০১৫

জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা ………..সুব্রতা রায় ত্রিবেদী



 

জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা ………..সুব্রতা রায় ত্রিবেদী

 
 
 
 
 
 
1 Vote


Probir Protim Roy's photo.
রথযাত্রা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব। বৈদিক সমাজে প্রথমে এ জাতীয় কোন উৎসবের প্রচলন ছিল না। স্নানযাত্রা, দোলযাত্রা, রথযাত্রা প্রভৃতি উৎসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল সমাজের অভিজাত শ্রেণীর ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধরা। সম্রাট অশোক এসবের বিরুদ্ধে অনুশাসনও জারি করেছিলেন। কিন্তু কোন অনুশাসনই লৌকিক ধর্মের এ প্রবাহকে প্রতিহত করতে পারেনি।
গ্রিক, মিসরীয় ও ভারতীয় সভ্যতায় সপ্তাশ্ববাহী সূর্য প্রধান দেবতা এবং অন্যান্য দেবতা তারই রূপানত্মর। প্রাচীন হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্র মতে, পৃথিবী সূর্যের প্রদৰিণের সূত্রই রথযাত্রা এবং এই রথযাত্রাই নববর্ষের ইঙ্গিত বহন করে।
আচার্য রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীর মতে, “দিবাকরের রথচক্র মহাকালের পদাঙ্ক অনুসরণ করিতেছে। উত্তর হইতে দৰিণে, দৰিণ হইতে উত্তরে তাহার রথচক্র প্রবর্তিত হইয়া মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর, মহাকাল দেহে অঙ্কিত করিয়া চলিতেছে।’ অতএব রথযাত্রা সূর্যের উত্তরায়ণের পর দৰিণায়ণ, দৰিণায়ণের পর উত্তরায়ণ, যাত্রার পর পুনর্যাত্রা, জগন্নাথের রথযাত্রা হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রাচীনতম সভ্যতার অবিমিশ্র বিভিন্নমুখী ধারারই সমন্বয়।
রথযাত্রা হিন্দুদের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাণের উৎসব। মিলনের এক মহামেলা। বর্ষাঋতুর আগমনের শুরুতেই এই উৎসব গ্রামে-গঞ্জে নগরে বিপুলভাবে সর্বজনীন রূপ নেয়। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে বর্ষাবিধুর আবহাওয়ার মধ্যেও বহুস্থানে মেলা বসে। বিপুল জনসমাগম ঘটে।
সাধারণত, রথযাত্রা বলতে আমরা আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়াতে অনুষ্ঠিত শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রাই বুঝি_ যদিও অন্য দেবতাদেরও রথযাত্রা আছে। জৈন ও বৌদ্ধদেরও এক সময় রথযাত্রা ছিল।
রথযাত্রার মূলে রয়েছে বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব। কালের পরিক্রমায় হিন্দু সভ্যতার উত্থানকালে এ রথযাত্রা ‘শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা’ হিসেবে বিবর্তিত হয়েছে। এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
শ্রী জগন্নাথ আসলে ভগবান বিষ্ণুরই অবতার। অনেকের মতে, শ্রী জগন্নাথের এই মূর্তিরূপ শ্রী ভগবানের অসম্পূর্ণ রূপেরই প্রতিচ্ছবি। কারও কারও মতে, এই অসমাপ্ত, অসম্পূর্ণ মূর্তি নিরাকার ব্রহ্মারই প্রতিরূপ। আবার কারও কারও মতে, এ ত্রিমূর্তি বৌদ্ধ ত্রি-রত্নের প্রতীক। ধর্মমঙ্গল সাহিত্যে শ্রী জগন্নাথ ত্রি-রত্নের প্রথম রত্ন হিসেবে আখ্যায়িত। পরে অবশ্য হিন্দু পুরাণাদিতে নবম অবতার হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন। ওড়িশার লোকগীতিতে আমরা শ্রী জগন্নাথ ও বুদ্ধদেবকে অভিন্ন মূর্তিতে দেখতে পাই। এঁদের অবলম্বন করে অনেক লোককাহিনী প্রচলিত আছে।
এই রথ উৎসব পুরীর শ্রী জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকেন্দ্রিক উৎসব। শ্রী জগন্নাথ ও বিষ্ণু অভিন্ন। শুধু রূপভেদ মাত্র। ওড়িশার পুরীর জগন্নাথ ধামের রথযাত্রা জগদ্বিখ্যাত। পুরীর শ্রী জগন্নাথ সারা ভারতবর্ষেই পূজিত। জ্যৈষ্ঠে স্নান-যাত্রায় ও আষাঢ়ে রথের সময় বিশেষ জাঁকজমকের সঙ্গে পূজিত হন।
এই উৎসব আষাঢ়ের শুক্লা দ্বিতীয়াতে সম্পন্ন হয়। এদিন শ্রী জগন্নাথ ও বলরাম, স্নান সমাপন শেষে নূতন রথে আসীন হয়ে এক মাইল দূরে বৃৰলতাদি শোভিত উদাম গৃহে গমন করেন। এখানে সাতদিন অবস্থান শেষে আবার স্বস্থানে প্রত্যাগমন করেন। এটাই পুনর্যাত্রা বা উল্টোরথ। এ বছর আমাদের ১৯ আষাঢ়, ৩ জুলাই রথযাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। আবার ২৭ আষাঢ়, ১১ জুলাই উল্টোরথ পালিত হবে।
চৈতন্য মহাপ্রভুই মূলত নীলাচলে ভক্তিবাদের প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের অবতার। তাঁর প্রেম, ভক্তি ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’_ এসব মূলমন্ত্রই তাঁর জীবন-দর্শন। জগন্নাথও তাই। মহাপ্রভুর জীবন-দর্শন শ্রী জগন্নাথের জীবন-দর্শন মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। তাই তো পুরীকে বলা হয় বৈষ্ণবের ধাম। মহাপ্রভুর ভক্তিবাদ, সার্বজীবে সমদৃষ্টি পুরীধামে মহাপ্রভুকে এত জনপ্রিয় এত কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত করেছে।
এই ধাম রাধা-কৃষ্ণের রূপক মহিমা গীত হয়ে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। রাধা-কৃষ্ণকে অবলম্বন করে রচিত বৈষ্ণব কবিতা মূলত ভক্তিমূলক গীতি কবিতা। তবে শাশ্বত মানব-হৃদয়ের আকুল আর্তি, বিরহ, প্রেম সুন্দর রূপ লাভ করেছে। বৈষ্ণব কবিতায় হৃদয়ের ব্যাকুলতা, ভালবাসার যে আর্তি তা দেখে রবীন্দ্র কবি চিত্তে চিরনত্মন প্রশ্ন_
“সত্য করে কহো মোরে হে বৈষ্ণব কবি,
কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমচ্ছবি
কোথা তুমি শিখেছিলে এই প্রেমগান
বিরহ-তাপিত। হেরি কাহার নয়ান
রাধিকার অশ্রম্ন-অাঁখি পড়েছিল মনে?”
বৈষ্ণব কবিতা আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। চৈতন্য দেবের শুভ-আর্বিভাব না হলে হয়ত বৈষ্ণব পদাবলীর এই ঐশ্বর্য থেকে আমরা বঞ্চিত হতাম। রাধাকৃষ্ণের প্রণয় লীলা শুধুই রোমান্টিসিজম নয়। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সাধনা, তত্ত্ব এতে মূর্ত হয়ে উঠেছে। বৈষ্ণব কবিতা বাংলার নিজস্ব সম্পদ। ভাব, ভাষা ও ব্যঞ্জনায় অপূর্ব সৃষ্টি।
বাংলাদেশের অনেক স্থানের নাম ‘রথখোলা’ ও ‘রথবিহার’ নামে পরিচিত এবং এসব স্থান ও মন্দিরে আখড়ায় রথ-উৎসব পালন করা হয়। ঢাকা জেলার ধামরাই গ্রামে যশোমাধবের সুবিখ্যাত রথযাত্রা উপলৰে বিরাট মেলার সমাবেশ হয়।
কুমিলস্না শহরের জগন্নাথ বাড়ির রথযাত্রা বিখ্যাত। অতি শৈশবে সেখানে রথের মেলা ও উৎসবের ঘনঘটা দেখেছি। শ্রী চৈতন্য দেব ব্যাপকভাবে রথযাত্রা উৎসবের প্রচলন করেছিলেন। শ্রী প্রভুপাদ বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে সুদূর ইউরোপ ও আমেরিকায় এর প্রচলন করেন।
ঢাকায় নারিন্দায় ইসকনের রথের উৎসব ও শোভাযাত্রা মিছিল, তাঁতী বাজারে শ্রী জগন্নাথ জিউ মন্দিরের উৎসব ও মেলা সবিশেষ উলেস্নখযোগ্য। তাছাড়া সিলেট, যশোর, পাবনা, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম প্রভৃতি স্থানে এ উপলৰে মেলা ও উৎসরের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
রথযাত্রা আমাদের এক প্রাণের উৎসব। মিলনের এক মহামেলা। এই মেলা বাঙালীর ঐতিহ্য। সে কারণে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে এই রথ-উৎসবে সবাই যোগদান করে থাকে।

শনিবার, ২৫ জুলাই, ২০১৫

গীতগোবিন্দ বামন রূপ



 গীতগোবিন্দ 

ছলয়সি বিক্রমণে বলিমতভুত বামন ।

পদ নখ নীর জনিত জন পাবন ।।

কেশব ধৃত বামন রূপ জয় জগদিশ হরে ।।

সোমবার, ২০ জুলাই, ২০১৫

মা লক্ষ্মী




     
   
  দেবী লক্ষ্মী হলেন ধন সম্পদের দেবী। আদিশক্তির রাজসিক স্বরূপ । অগ্নি পুরাণ মতে শ্রী বা লক্ষ্মী হলেন যজ্ঞবিদ্যা , তিনিই আত্ম্যবিদ্যা , যাবতীয় গুহ্যবিদ্যা ও মহাবিদ্যা ও তিনি –‘যজ্ঞবিদ্যা মহাবিদ্যা গুহ্যবিদ্যা চ শোভনা ।আত্ম্যবিদ্যা চ দেবি বিমুক্তিফলদায়িনী ।।’ দেবী ভাগবত মতে যে স্বর্গে তিনিই স্বর্গ লক্ষ্মী , রাজগৃহে তিনি রাজলক্ষ্মী , গৃহে তিনি গৃহলক্ষ্মী । তিনি শান্তা , দান্তা , সুশীলা , সর্ব মঙ্গলা , ষড়রিপু বর্জিতা ।
পুরানে আছে সাগর মন্থন কালে দেবী লক্ষ্মী সমুদ্র থেকে প্রকট হন । সাগর হল লক্ষ্মী দেবীর পিতা । সাগরেই মুক্তা , প্রবাল আদি রত্ন পাওয়া যায় । রত্ন হল ধন , যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন লক্ষ্মী । এই হল দেবী লক্ষ্মীর সামগ্রিক স্বরূপ । দশ মহাবিদ্যার দশম মহাবিদ্যা কমলা দেবী হলেন মা লক্ষ্মী। স্বতন্ত্র তন্ত্র নামকএক তন্ত্র শাস্ত্র মতে কোলাসুর নামক এক অসুরকে বধ করার জন্যই দেবী কমলার আবির্ভাব । বারাহী তন্ত্র মতে পুরাকালে প্রজাপতি ব্রহ্মা, ভগবান বিষ্ণু, ভগবান শিব এই কমলা দেবীকে পূজা করেন বলে কমলা মায়ের এক নাম ‘ত্রিপুরা’ ।
মা লক্ষ্মী কমল আসনে থাকেন। কমল হল সর্বাত্মক বিকাশের প্রতীক ।
এমন কথিত আছে মা লক্ষ্মী পদ্মা নদী রূপে বঙ্গদেশে প্রবাহিতা আবার গঙ্গা , গোদাবরী , কৃষ্ণা , সিন্ধু রুপে ইত্যাদি ভারতের বিভিন্ন নদির অববাহিকাতে শশ্য শ্যামলা করে তুলেছেন । তার জলে বঙ্গদেশ ও ভারতবর্ষের মৃত্তিকা হয়েছে উর্বরা , শস্যে ভরা । তিনি কৃষিজ লক্ষ্মী। লাঙ্গল কর্ষণ কালে লক্ষ্মী অবতার সীতা মায়ের আবির্ভাব । লাঙ্গল দিয়ে জমিতে হাল বয়ে জমি উর্বরা করে চাষাবাদ করলেই মাঠ ভরে উঠবে সোনালী ধানে। এদিক থেকে তিনি কৃষি লক্ষ্মী। তাই ভাদ্র মাসে,পৌষ মাসে কৃষি লক্মী পূজা হয় প্রায় ঘরে। খনিজ লক্ষ্মী বলে সোনার দ্রব্য বোঝায়। সোনাকে আমরা মা লক্ষ্মীর সাথে তুলনা দিয়ে থাকি। ঐশ্বর্যের আর এক উৎস সমুদ্র। পুরান বলে সাগর মন্থন কালেই দেবী বিষ্ণুপ্রিয়ার আবির্ভাব। সাগরে ডুব দিয়ে প্রবাল, শঙ্খ, কড়ি আদি রত্ন সামগ্রী পাওয়া যায়। বানিজ্য করতেও দেখা যায় এই দেবীর আশীর্বাদের প্রসঙ্গ। নববর্ষে দোকানে ব্যবসায়ী গণ গণেশের সহিত মা লক্ষ্মীর পূজো করেন । এছাড়া লক্ষ্মী পূজোতে কলা গাছের কান্ড দিয়ে নৌকা বানিয়ে পূজোতে দেওয়া হয়, তা বানিজ্য ও লক্ষ্মী ঘরে আনারই প্রতীক। শ্রী রামচন্দ্র সীতা মাতা উদ্ধারের জন্য বা রাজা সুরথ রাজ্য উদ্ধারের জন্য এই মহালক্ষ্মী স্বরূপা দুর্গা দেবীর পূজা করেছিলেন। এই ভাবে লক্ষ্মী দেবীর একটি রূপ আমাদের সামনে ফুটে ওঠে ।
কোজাগোরী পূর্ণিমা বা শারদ পূর্ণিমাতে আমরা মা লক্ষ্মীর পূজো করি, যদিও দীপাবলি তেই সমগ্র দেশে পূজিতা হন। পূর্ণিমার চাঁদের আলো যখন দিগ দিগন্তে সন্ধ্যার কালো আঁধার কাটিয়ে আলোর ছটা ছড়িয়ে পড়ে, তখন উলু, শঙ্খ ধ্বনি সহকারে আমরা মা লক্ষ্মীর পূজার্চনা করি। এমন বলা হয়, দেবী জেগে খবর নেন- কে জেগে আছে –
নিশীথে বরদা লক্ষ্মীঃ জাগরত্তীতিভাষিণী ।
তস্মৈ বিত্তং প্রযচ্ছামি অক্ষৈঃ ক্রীড়াং করোতি যঃ ।।
কো জাগর্ত্তি – কে জেগে আছে ? কোজাগোরী শব্দের অর্থ এমন টাই । মা দ্বারে দ্বারে আশিষ দিয়ে যান, যে জেগে থাকে সে পায় আশিষ, কিন্তু যে ঘুমায় সে ঘুমিয়েই থাকে । আর অক্ষ ক্রীড়া মানে কিন্তু জুয়া খেলা নয়। ‘অক্ষ’ শব্দের অনেক প্রকার মানে হয় । এর মানে হয় ‘ক্রয় বিক্রয় চিন্তা’। বৈশ্য গণ এদিন জেগে ব্যবসা বানিজ্য করে ঘরে লক্ষ্মী আনার চিন্তা করেন। অক্ষ শব্দের আর এক মানে হয় জপ মালা। যারা সত্ত্ব গুনের তারা এই রাত্রি মায়ের নাম জপ করেই কাটাবেন। কো জাগর্ত্তি শব্দ তাদের কাছে আত্ম চৈতন্যের বানী। দেবীর বাহন হলেন পেঁচক। পেঁচক দিনে ঘুমায় রাতে জাগে। সাধারন মানুষ যখন ঘুমায়, পেঁচক জাগে। এ ঠিক যোগীর অবস্থা। সাধারন মানুষ যখন নিদ্রামগ্ন, যোগী তখন যোগ সাধনায়। পেঁচক ইঁদুর ভক্ষণ করে কৃষকের শস্য রক্ষা করে। এদিক থেকে এই প্রানীটি সত্যই আমাদের কাছে মা লক্ষ্মীর বার্তা, ভাব বয়ে আনে ।

শুক্রবার, ১০ জুলাই, ২০১৫

সামবেদ ভূমিকা





সামবেদ ভূমিকা  


‘বেদ’ শব্দটির সঙ্গে আমরা পরিচিত হলেও বেদ সন্বন্ধে আমাদের অজ্ঞতা পর্বত প্রমাণ। বেদ বিদ্যা দুইপ্রকার, পরাবিদ্যা ও অপরাবিদ্যা।
যে বিদ্যার চেয়ে শ্রেষ্ঠ বিদ্যা আর কিছু নেই, যে বিদ্যার সন্ধান পেলে আর কিছুই জানার বাকী থাকে না তা পরাবিদ্যা। কি সেই জ্ঞান যা জানলে পরে আর কিছুই জানার বাকী থাকে না? সে জ্ঞান বিশ্ব জ্ঞান। এই বিশ্বজ্ঞান কাকে আশ্রয় করে আছে? এই বিশ্বজ্ঞান স্বয়ং প্রকাশ। ইনি স্ব-ইচ্ছায় জাত হয়েছেন। ইনি স্ব-ইচ্ছায় কর্ম করে থাকেন। ইনি তাই আত্মজন্ম ও আত্মকর্মা। ইনি কখন জাত হলেন? ইনি যখন জাত হলেন তাঁর পূর্বে কি ছিল? ইনি যখন জাত হলেন তখন তাঁর পুর্বে তিনি ছিলেন সেই বস্তুর দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে যে বস্তুর অস্তিত্ব ছিল না আর সমস্ত কিছুই চিহ্ন বর্জিত ছিল। তখন যা নেই তাও ছিল না, যা আছে তাও ছিল না। তখন মৃত্যুও ছিল না, অমরত্বও ছিল না। রাত্রী ও দিনের প্রভেদ ছিল না। তখন কেবলমাত্র সেই বস্তু যিনি আত্মজন্ম, স্বয়ম্ভু আত্মা, তিনি বায়ুশূন্য প্রাণনক্রিয়া করছিলেন, আর তাঁর যে অবিদ্যমান বস্তু স্বীয় মায়া বা প্রজ্ঞা, তার সঙ্গে অবিভাগাপন্ন ছিলেন। তাই আত্মা ব্রহ্ম তখন সৎও ছিলেন না, অসৎও ছিলেন না। কেবলমাত্র স্বীয় মায়ার সঙ্গে অবিনাভাবে অতি ক্ষুদ্ররূপে, যার চেয়ে আর ক্ষুদ্র কিছু হয় না, সেইভাবে অবস্থান করে বায়ুশূন্য প্রাণনক্রিয়া সহায়ে নিজেই নিজের মায়া সহকারে নিজে নিজেই জ্বলছিলেন। তিনি আত্মজন্ম বলে তাঁর মায়ারূপ প্রজ্ঞা কর্মকে ইচ্ছা করলো। তখন তাঁর ইচ্ছাকে তিনি বর্ধিত করলেন, অবিনাভাব মায়াকে সঙ্গে নিয়ে। তিনি ঊর্ধ্বগতিযুক্ত হলেন। এই ঊর্ধ্বগতি হওয়ার ইচ্ছামাত্রই তাঁর প্রাণশক্তির বল বৃদ্ধি পেল। এই বৃদ্ধির ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে যেমন আকাশ সৃষ্টি হোল তাঁর বলকার্যকে ধারণ করার জন্য, তেমনি তাঁর বৃদ্ধি পাবার ইচ্ছা মাত্রই তিনি গতিযুক্ত হলেন। তিনি অগিযুক্ত বা গতিযুক্ত (অগি ধাতু গতি অর্থে) হয়ে তার বৃদ্ধিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকলেন। তাই তিনি হলেন ‘অগ্নি’। তাঁর এই বৃদ্ধি শিখাযুক্ত হোল গার তা হোল ঊর্ধ্বগতিযুক্ত। তিনি ছিলেন ‘দহর’ অতি ক্ষুদ্র, এখন হলেন ‘অগ্নি’ সব কিছুকেই এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য; বহন করবার জন্য; এবং সকলের আগে সকল কর্মে আগে আগে থাকবার জন্য। আর তিনি যে অগ্নিরূপে বৃদ্ধি পেতে লাগলেন সেই বৃদ্ধি ক্ষণস্থায়ী হোল না। অনন্তকাল ধরে তিনি বেড়ে চললেন। তিনি ঊর্ধ্বগতিযুক্ত হলে, তাঁর রশ্মিসকল ঊর্ধ্বগতিযুক্ত হলে, তার সেই বলকার্যকে ধারণ করার জন্য যে মহাশূন্য মহাকাশ সৃষ্টি হয়েছিল সেই মহাকাশে মহাশূন্য সেই ঊর্ধ্বগতিযুক্ত রশ্মিসকল শয়ন করলো। আর সেই মহাশূন্যে রশ্মিরা শয়ন করে নমিত হয়ে পড়লো আর শুভ্র জ্যোতি ধারণ করলো। এই যে জ্যোতির্ময় ব্রহ্ম এ অবিনাশী অক্ষয় সনাতন। আর এই জ্যোতির মধ্যেই সমস্ত ভুবন সমস্ত লোক আশ্রিত। এঁকে অতিক্রম করে যেতে পারে এমন কোন বস্তু এ ভুবনে নেই। এই যে জ্যোতির্ময় ব্রহ্মরূপে আত্মা এর জ্যোতি হিরণ্যময়। মহাশূন্যে মহাকাশে ইনি হিরন্ময় জ্যোতিরূপে স্বীয় মায়ারূপ প্রজ্ঞার দ্বারা ব্যাপ্ত হয়ে নিজের মধ্যেই আহার ঘুরে এলেন অন্ডাকৃতি ধারণ করে। অন্ডের মধ্যের জীব যেমন আহরণের মধ্যে থেকে প্রাণননক্রিয়া করে যেতে থাকে ইনিও তেমন হিরণ্ময় আবরণসুক্ত অন্ডাকৃতি ধারণ করে এই বিশাল ব্রহ্মান্ডের মধ্যে প্রাণনক্রিয়ায় ব্যাপ্ত রইলেন স্বীয় মায়ারূপ প্রজ্ঞার সঙ্গে অবিভাগাপন্ন হয়ে ঠিক সেইভাবে যখন তিনি সৃষ্টির প্রারম্ভে অবিদ্যমান মায়াবস্তুর সঙ্গে যুক্ত থেকে বায়ুশূন্য প্রাণনক্রিয়া করছিলেন। হিরন্ময় অন্ডের গর্ভভূত সেই অনন্ত বিশাল ব্রহ্মান্ডের পূর্বে শয়ন করে তিনি ‘পুরুষ’ নামে খ্যাত হলেন। সেই হিরণ্যগর্ভভূত অন্তরপুরুষ যিনি সর্বগত, যাঁর দ্বারা সর্বজগৎ ব্যাপ্ত, যিনি সকলের অন্তরে বিরাজ করেন, তিনিই পরমব্রহ্ম পরম-আত্মা। তিনি যখন সর্বজগৎ ব্রহ্মান্ডরূপে ব্যাপ্ত করলেন তখন তিনি বহু হবার কামনা করে প্রকৃষ্টরূপে জাত হলনে। তিনিই জাত হলেন ‘প্রজা’রূপে আর তিনিই তার পালয়িতা হলেন বলে তিনি ‘প্রজাপতি’ রূপেও খ্যাত হলেন। ছিলেন ‘দহর’ অতি ক্ষুদ্র, হলেন ব্যাপ্ত বহুরূপে; আর সকলের অন্তর পুরুষরূপে সকলপুরে সকলদেহে শায়িত হলেন, অধিষ্ঠিত হলেন, অধিষ্ঠিত হলেন বিন্দুবৎ অতি ক্ষুদ্ররূপে। তিনি যখন ব্যাপ্ত হলেন তখন সেই পুরুষ হলেন সহস্র মস্তক, সহস্র চক্ষু, সহস্র চরণ। কিন্তু তিনি সকল কিছু হয়ে ও সব কিছুকে অতিক্রম করে ক্রান্তদর্শীরূপে সকল কিছুর ঊর্ধ্বে অবস্থান করলেন। নিজের সৃষ্টির চেয়ে তিনি মহৎ হয়ে রইলেন। এই যা হয়েছে আর ভবিষ্যতে যা হবে সকলই সেই পুরুষ। এই বিশ্বজীব তার এক আওংশ মাত্র, যা ভূত ভবিষ্যৎ ও বর্তমান এই তিন কালের সংসারচক্রের মধ্যে অবস্থিত। সেই পুরুষের অপর যে তিন অংশ তা এই তিনকালের অতীতরূপে ঊর্ধ্বে সেই পরমস্থানে অবস্থান করলো যে পরমস্থানের বিষয় মানুষের চিন্তাজগতের অনধিগম্য। সেই পুরুষ যে এক অংশের দ্বারা চেতন ও অচেতন সকল পদার্থকে ব্যাপ্ত করলেন তা থেকে যজ্ঞের সুত্রপাত। যিনি এক অদ্বিতীয়রূপে ছিলেন তিনি বহুরূপে বিচিত্র লীলা করবার ইচ্ছা করলেন। তিনি যাচ্ঞা করলেন; তিনিই পূজা করলেন; তিনিই বহু হয়ে সকলের সঙ্গে মিলিত হলেন; তিনিই নিজেকে নিজে সকল কর্মে দান করলেন, অর্পণ করলেন। আর এ সকলই যজ্ঞকর্ম এবং তিনিই স্বয়ং যজ্ঞ। আর এই যজ্ঞ কর্মে তিনিই প্রথম বলি। তিনি তাবৎ বস্তুকে নিরীক্ষণ করলেন সমান দৃষ্টিতে; তাই তিনি পশু। আর তিনিই প্রথম যজ্ঞীয় পশুরূপে নিজ বহ্নিতে আহুতি দিলেন। সেই অগ্নিই নিজেকে নিজে অগ্নিতে আহিতি দিলেন, বিভিন্ন আকৃতিতে খন্ড খন্ড হলেন, আর সেই আহিতিভারকে স্বয়ং বহন করে চললেন অনন্তকাল ধরে মহাশূন্য মহাকালরূপে। এই কালই অশ্ব যা সকল কিছু বহন করে নিয়ে চলে। এই যজ্ঞীয় অশ্বের শীর্ষে রইলেন ঊষা – প্রথম আলোর চরণধ্বনি। তাঁর পশ্চাতে আগমন করলেন সূর্য চক্ষুরূপে, যিনি সর্বলোককান্ত, যিনি সর্বলোকের দ্রষ্টা। এই মহাভোজী অশ্বরূপী মহাকাল সপ্তরশ্মি, অবিনাশী, অজর, সহস্রচক্ষু, ভূরিরেতা, যা বহু প্রজননের অধিকারী এবং যার গর্ভে জন্মবীজ নিহিত। বহু প্রজননের জন্য এই কালকেই মানুষ পূজা করে। এই কালের চাকা এই বিশ্বভূবন। এই কালচক্রেই আরোহণ করে মানুষের মধ্যে যাঁরা উত্তমদ্রষ্টা সেই ঋষিগণ এই ব্রহ্মকে নিরীক্ষণ করলেন। আর সে পুরুষ যিনি এইভাবে সব হয়েছেন, তিনিও এই সব নিরীক্ষণ করলেন। তিনি এই সব সৃষ্ট জগতের মধ্যে প্রবেশ করতে চাইলেন। আর তার সৃষ্ট জগতে প্রবেশ করতে ইচ্ছা করে তিনি যখন বিশ্বকে নিরীক্ষণ করলেন তখন নিজেই বলে উঠলেন – ‘অহো, আমিই আমাকে আমার আত্মস্বরূপে এই স ‘ইদম্’ রূপে দেখলাম।’ সেই ‘ইদম্’-ই প্রত্যক্ষভাবে পরমাত্মা। তিনিই ‘ইদম্’ রূপে দ্রষ্টা হয়ে ‘ইদন্দ্র’ নামে খ্যাত হলেন। এই ‘ইদম্’-ই পরোক্ষভাবে ‘ইন্দ্র’ নামে অভিহিত।
কিন্তু এই যে দৃশ্যমান বস্তু যা বহুপ্রকারে বহুরূপে জাত, তা কোথা হতে সৃষ্টি হোল? কেই বা তা দেখেছে? কেই বা তা বলে দেবে? যে উপাদান কারণ থেকে এই সর্বজগতের উৎপত্তি তা তো পরে জন্মেছে। যারা পরে জন্মেছে তারা কেমন করে বলবে সৃষ্টির উপাদান কারণ কি? যিনি এই সমস্ত সৃষ্টির কারণ তিনি হয়তো একে ধারণ করে আছেন, হয়তো নেই। যিনি স্বীয় মহিমার সত্যস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এই জগতের অধ্যক্ষরূপে পরম ব্যোমে অবস্থান করছেন তিনিই হয়তো এইসব জানেন, হয়তো জানেন না। তবে কে দেখলো এই সব? কে-ই বলবে সে কথা?
এই প্রশ্ন চিরন্তন। এ প্রশ্ন ঋষির, আর এই প্রশ্নের উত্তর জানবার জন্য মানুষদের মধ্যে যাঁরা শ্রেষ্ট মানুষ তারা, করে কোন্ যুগে কত দীর্ঘ হাজার হাজার বছর আগে, তা কেউ জানে না, কোন কিছু অধ্যয়ন না করে তপস্যায় বসলেন, সৃষ্টিরহস্যের সন্ধানে। এই বেদ বা জ্ঞানলাভের জন্য স্বভাবনির্মল তপস্যানিরত মনুষ্যশ্রেষ্ঠদের সামনে স্ব্যয়ম্ভু স্বয়ং উপস্থিত হলেন। আর তখন তাঁরা ব্রহ্মকে সমগ্র বেদকে সমস্ত জ্ঞানকে স্বরূপে দর্শন করে ব্রহ্মজ্ঞানী হয়ে ব্রাহ্মণরূপে অভিহিত হলেন। যেখানে নয়ন গমন করে না, সেখানে বাক্য গমন করে না, সেখানে মনও গমন করে না, যে ব্রহ্মের স্বরূপ নিজেরই জানা নেই তা অপরের জ্ঞানের বিষয়ীভূত কিভাবে করা যাবে? তাই তপস্যারত পুরুষদের সামনে স্বেচ্ছায় শরীর পরিগ্রহ করে স্বয়ং বেদ যখন উপস্থিত হলেন তখন-ই তা জ্ঞানের গোচর হল। আর এইভাবেই বিনা অধ্যয়নে দর্শনক্রিয়ার দ্বারা সমগ্র বেদরাশি সেই তপস্যানিরত পুরুষদের সামনে স্বয়ং সমাগত হয়েছিলেন বলে সেই ব্রাহ্মণগণ ঋষি হয়েছিলেন। এই ঋষিগণ সেই ধর্মের (=যাঁর দ্বারা সকল কিছু ধৃত) সাক্ষাৎ দ্রষ্টা হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে যাঁরা ধর্মকে সাক্ষাৎ করেন নি অথচ সমগ্র বেদরহস্য জানতে ইচ্ছুক ছিলেন সেই পরবর্তীকালের ঋষিদের পূর্ববর্তী সাক্ষাৎধর্মা ঋষিগণ সমগ্র বেদরহস্য মন্ত্রের দ্বারা উপদেশের দ্বারা প্রদান করেছিলেন।
এই যিনি ইন্দ্রিয়জ্ঞানের অগোচর – অদৃশ্য, কর্ম-ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যাঁকে গ্রহণ করা যায় না – অগ্রাহ্য, যাঁর মূল জানা নেই – অগোত্র, যিনি সকল বর্ণ ও রূপের কারণ হয়েও নিরাকার – অরূপ, যিনি সর্বদর্শনকারী হয়েও চক্ষুহীন – অচক্ষু, যিনি সর্বশ্রবণ সমর্থ হয়েও কর্ণহীন – অশোত্র, যিনি সর্বকর্মকারী এবং সর্বত্রগমনকারী হয়েও হস্তপদ-বিহীন – অপাণিপাদ, যিনি নিত্য, বিবিধপ্রকারে বর্তমান থেকে বিভু, যিনি সর্বগত, যিনি সূক্ষ্মাতি-সূক্ষ্ম, যিনি অব্যয় এবং সর্বভুতবর্গের কারণ, তাঁকেই বিবেকীরা ‘পরাবিদ্য’ রূপে সর্বত্র দর্শন করেন। ইনিই পরাবিদ্যা, ইনিই সর্বজ্ঞ, সর্ববিদ্, ইনি-ই সর্বজ্ঞানময় তপস্যা, ইনি-ই ব্রহ্ম, ইনি-ই রূপ, ইনি-ই অমৃতরূপে বারি, ইনি-ই অন্নরূপে জাত। এই পরাবিদ্যার দ্বারা সেই অক্ষর অনিনাশী ব্রহ্মকে জানা যায়। এই অক্ষর হতেই অন্ন, অন্ন হতে প্রাণ, প্রাণ হতে মন, মন হতে সত্য, সত্য হতে লোকসমূহ, লোকসমূহ হতে অমৃতত্ব জাত হয়ে জাগতিক ক্রম সম্পূর্ণ হয়। সেই প্রজ্বলিত তপস্যা থেকে ঋত জাত হোল, যজ্ঞ জাত হল, দিবা ও রাত্রি জাত হোল, জলপূর্ণ সমুদ্র জাত হোল, সংবৎসর জাত হোল; আর কালের নিয়মনিবদ্ধগতিকে পরিচালনার জন্য নক্ষত্রলোক, সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী ও অন্তরিক্ষ জাত হোল। এই জাগতিক সুনিয়ত কার্যক্রম ‘ঋত’ শব্দবাচ্য। এই ঋত-ই সত্য, যজ্ঞ, জল ও ধন নাম খ্যাত। আর যিনি ঋতকর্মের ধারক তিনিও ঋতদেবতা; ঋতম্ভর। তিনি অমৃতবারিরূপে; ‘ঋতং বৃহৎ’। তিনি হংসের মত শুদ্ধ অমৃতবারিকে আশ্রয় করে সর্বত্রগামী হয়ে দ্যুলোকে আদিত্যরূপে অধিষ্ঠিত। তিনি অন্তরিক্ষে বায়ুরূপে, তিনি পৃথিবীতে পার্থিব অগ্নিরূপে, তিনি অমৃতবারি সোমরূপে, তিনি সকল দেবতারূপে, আকাশরূপে সত্যরূপে, নদী, অন্ন, পর্বত – এই যা কিছু সব হয়েছে। কারণ তিনি যে মহান।
কিন্তু আ তো পরাবিদ্যা, তত্ত্বকথা। যিনি তপস্বী, যিনি তত্ত্বজ্ঞ, যিনি ঋষি তিনি এসব বুঝতে পারেন, দর্শন করতে পারেন এবং তত্ত্বকে জেনে তত্ত্বসন্বন্ধী যথার্থ জীবন যাপন করতে পারেন। কিন্তু যাঁরা কর্মব্যস্ত মানুষ যাঁদের নিত আহার সংগ্রহ করতে হয়, যা%রা সুখে শান্তিতে কালাতিপাত করতে চেন, যারা অন্নের উপায় জানতে চান, যাঁরা নিরোগদেহে নিরুপদ্রবে জীবনযাপন করতে চান, যাঁদের জন্য জীবনসংগ্রাম নিত্য সম্মুখ সমরের মত দুয়ারে দাঁড়ায়ে থাকে, যাঁরা অন্নময় প্রাণময় শরীর রক্ষায় সদা ব্যস্ত, তাঁদের জন্য এ তত্ত্ব কি মুল্য বহন করবে?
এ প্রশ্নের উত্তরও ঋষি দিয়েছেন। ঋষি বলেছেন – ব্রহ্মবিদ্ তো অন্নের নিন্দা করেন না। যাঁর অন্ন নেই তাঁর প্রজ্ঞাও নেই। যাঁর প্রজ্ঞা নেই তাঁর বলও নেই। যাঁর বল নেই তিনি এই আত্মাকে লাভ করতে পারেন না। আর আত্মাকে জানলেই পরাবিদ্যা লাভের পথ প্রশস্ত হয়। অন্নময় প্রাণময় মনোময় বিজ্ঞানময় আনন্দময় পুরুষই তত্ত্বগ্রহণে সমর্থ। আর যথার্থ তত্ত্বজ্ঞান সহায়ে জীবৎকালে মুক্ত অবস্থায় সকল কর্ম করেও অভয় ও সদানন্দ হন।
তবে কি ভাবে সংসারমার্গে বিচরণকারী মানুষ পরমজ্ঞান লাভ করতে পারে? এর উত্তরে বলা হয়েছে যে, মিথ্যাজ্ঞানজনিত যে বাসনা কামনা তা-ই ইহলোকের দুঃখের কারণ। এই মিথ্যাজ্ঞানজন্য যে বাসনা তা থেকে ক্রমমুক্তির উপায় জানতে হবে। আর তা জানবার জন্যই বেদের আলোচনা করতে হবে। পূর্বে বলা হয়েছে – দুটি বিদ্যাই জানবার আছে, একটি পরাবিদ্যা ও অপরটি অপরাবিদ্যা; সেই অপরাবিদ্যা পরাবিদ্যালাভের ইঙ্গিত দেয়। যে বিদ্যার ব্যবহারিক উপযোগিতা আছে, যা ইহলোকিক সুখের সন্ধান দেয় এবং পারলৌকিক মুক্তির উপায় তা অপরাবিদ্যা। সেই অপরাবিদ্যার মধ্যে ঋগ্বেদ, যজূর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দঃ ও জ্যোতিষ আলোচনার দ্বারা বিবেকী হওয়া সম্ভব। এই প্রযুক্তি বিদ্যাই দুঃখের পরপারে নিয়ে যেতে পারে; আত্মার সাক্ষাৎকার সহায়ক হতে পারে; দেবতার সঙ্গে সখ্যতা স্থাপনে সহায়ক হতে পারে। বালকেরা যেমন প্রথম বস্তুর নাম শেখে এবং পরে শিক্ষালাভের দ্বারা ক্রমে ক্রমে উৎকৃষ্ট জ্ঞান সঞ্চয় করে ও সেই জ্ঞানকে কর্মের সহায়রূপে নিযুক্ত করে, ঠিক সেইভাবে বেদচর্চার দ্বারা প্রতিটি মানুষ জ্ঞান অর্জন করে ইষ্টবস্তু লাভ করতে পারেন। সকল ব্যক্তিই যেমন চক্ষুকর্ণহস্তপদবিশিষ্ট হলেও সমান যোগ্যতাসম্পন্ন হন না তেমনি যার যেমন সাধনা যার যেমন যোগ্যতা সেই অনুসারে বেদচর্চা করলে ক্রমেই শ্রেয় লাভ করেন।
এখন দেখা যাক, যে ঋগ্বেদ, যজূর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দঃ ও জ্যোতিষ, যা অপরাবিদ্যা নামে অভিহিত হোল, তার আলোচ্য বিষয় কি? পূর্বে বলা হয়েছে, যিনি জগতের কারণ তিনি প্রথমে সূক্ষ্মাতি-সূক্ষ্ম রূপে স্বীয় মায়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি পরে তাঁর ইচ্ছামাত্র সেই ঐশী মায়াশক্তির সঙ্গে যুক্ত থেকে এই সব কিছু হলেন। তাঁর সেই অদীনা অক্ষীণা ঐশী মায়াশক্তি অদিতিই সকল কিছুর জন্ম দিয়েছেন বলে এই যা কিছু দৃশ্য পদার্থ তা আদিত্য নামে অভিহিত। তার মধ্যে আমাদের জীবকূলের প্রয়োজনে সূর্যরূপে যিনি জাত হলেন, তিনি জগতের চক্ষু, তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ বলে ‘আদিত্য’ নামে পরিচিত হলেন। এই সূর্যমন্ডলের অধীনে তিনলোক। সূর্য যেখানে যে পরমস্থানে (আধুনিক বিচারে নয় কোটি তিরিশ লক্ষ মাইল দূরে) বাস করেন, সেই স্থান দ্যুলোক। এই পৃথিবী যেখানে আমাদের বাসনা-কামনা সুখ-সম্পদ দুঃখ-ব্যাধি ভয়-নিরাপত্তা প্রভৃতি বর্তমান তা ভূলোক। দ্যুলোক ও ভূলোকের মধ্যবর্তী যে আকাশ তা তা অন্তরিক্ষলোক, স্বপ্নময়লোক। এই দ্যুলোক, ভূলোক ও অন্তরিক্ষলোক এবং এরই মধ্যবর্ত্তী আর যা কিছু সব সুর্যমন্ডলের অন্তর্গত। যিনি অগ্নিরূপে যাত্রা করেছিলেন সৃষ্টির প্রারম্ভে তিনিই দ্যুলোকে সূর্যরূপী অগ্নি, অন্তরিদখে বিদ্যুৎরূপী অগ্নি এবং পৃথিবীলোকে পার্থিব অগ্নিরূপে অধিষ্ঠিত হলেন। আর সূর্যমন্ডলের বাইরে সেই প্রম অগ্নি অসংখ্য নক্ষত্ররূপী জাত হলেন।
এই যে সূর্য ইনি প্রত্যক্ষ দেবতা। ইনিই আত্মা। আত্মার সাক্ষাৎকারের জন্য অনেকে অনেক উপায়ের সন্ধান দেন কিন্তু যিনি সূর্যতে আত্মার অধিষ্ঠানের বিষয় জানেন তিনি সহজেই আত্মার সাক্ষাৎকার করেন। প্রকৃতপক্ষে আত্মা আমাদের থেকে কখনও দূরে নেই। তিনি মানুষের মধ্যে অহং বা ‘আমি’ রূপে পরিচিত। আর তিনিই আত্মজন্মা ও স্বেচ্ছাজন্ম হয়ে স্বকার্যসাধনের জন্য প্রত্যক্ষভাবে সূর্যে অধিষ্ঠিত আছেন। যা দীপ্তি দেয় তাই ‘দেব’। ঐশ্বর্যদান করেন বলে তিনি ‘দেব’। তেজঃস্বরূপ বলে সকল পদার্থকে প্রকাশ করেন, তাই তিনি ‘দেব'; আর দ্যুলোকে অবস্থিত বলে তিনি ‘দেব’। যিনি দেব তিনিই দেবতা। আর সেই পরম অগ্নি যিনি সকল অগ্নিরূপে বিশ্বের সকল ভবনে সকলস্থানে অগ্নি নামেই খ্যাত হয়ে আছেন সেই অগ্নিই সকল দেবতা। এই পৃথিবীতে যিনি অগ্নিরূপে পরিচিত তিনিও সেই অগ্নি। বিশেষ কর্মে বিশেষ অধিকারের জন্য সেই আত্মারূপী একই অগ্নি বিভিন্ন নামে পরিচিত। তিনি ইন্দ্র-মিত্র বরুণ সুপর্ণ গরুতান্ মাতরিশ্বা যম অজ একপাৎ, ত্বষ্টা, বিশ্বানর, বৃষাকপি, আদিত্য, বিষ্ণু, পূষা, ভগ, রুদ্র, সবিতা কেশী প্রভৃতি নানা নামে বহুরূপে বর্ণিত হন। আর এই যে আদিত্য সূর্য এঁর রশ্মিসকলও দেবতা। এই কিরণরাশিই ‘দেবগণ’ বা ‘বিশ্বদেবগণ’ নামে পরিচিত। এই ‘বিশ্বদেবগণ’ কোন বিশেষ শ্রেণীর দেবগণ নন, এঁরা সকল দেবতার বোধক। তবে একথা সকলে স্বীকার করেন না। বিরুক্তকার শাকপূণি বলেন, বিশ্বদেবগণ বিশেষ ধরণের একশ্রেণীর দেবতা, যাঁরা বিশেষ কার্য সম্পন্ন করেন। এঁরা সংখ্যায় তেত্রিশ – দ্যুলোকে এগার, পৃথিবীতে এগার, এবং অন্তরিক্ষেও এগার। ব্রাহ্মণগ্রন্থে বলা হয়েছে, অষ্টবসু, দ্বাদশ আদিত্য, একাদশ রুদ্র, প্রজাপতি ও বষট্ কার – এই তেত্রিশ বিশ্বদেবগণ। এই বিশ্বদেবগণ নিজ মহিমায় সমস্ত যজ্ঞকর্মকে মিলিত করেন। মনে রাখতে হবে সকল সুকর্মই যা সকলের সঙ্গে মিলিত হয়, পূজিত হয়, পার্থিত হয় তা যজ্ঞকর্ম। সূর্য মন্ডলের অধীনে গণদেবতাদের মধ্যে বসুগণ, রুদ্রগণ, আদিত্যগণ, মরুৎগণ, সপ্তঋষিগণ, সাধ্যদেবগণ, বাজিগণ, বিশ্বদেবগণ, ঋভুগণ, আঙ্গিরোগণ, পিতৃগণ, অথর্বগণ, ভৃণ্ডগণ, আপ্তাগণ, দেবপত্নীগণ প্রধান। এই গণদেবতারা কর্মবিভাগ অনুসারে পৃথক পৃথক। বলা বাহুল্য, এঁরা সকলেই সূর্যের রশ্মির বিভিন্ন কার্যসাধনরূপ; যেমন মরুৎগণ প্রাণবায়ু, আদিত্যগণ সূর্যের দ্বাদশমাসের দ্বাদশরূপ, রুদ্রগণ রোগ উৎপন্ন করে বিনাশসাধন করেন, সাধ্যগণ বৃষ্টিদানরূপ অসাধ্য সাধন করেন, দেবপত্নীগণ জলের পালিকা শক্তি, বাজিগণ যজ্ঞকর্মকে ব্যাপ্ত করেন, ভৃণ্ডগণ বাষ্পীভূত বারিরাশিকে শুষ্ক করেন, বসুগণ সর্বলোকে ব্যাপ্ত ধনদানকারী রশ্মি, পিতৃগণ সূর্যের দক্ষিণায়ন-কালীন বর্ষণকারী রশ্মি, অথর্বগণ অগতিস্বভাব স্থিররশ্মি ইত্যাদি। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, বিরুক্তকারগণ বলেন, সকল রশ্মিই সমান দীর্ঘ নয় বা বিস্তৃত নয় এবং সকলের কর্মসম্পাদ ক্ষমতাও সমান নয়, রশ্মিগনের মধ্যে পাঁচটি অশ্বরশ্মিই দীর্ঘাকার। বৃষ্টিপ্রধান, জলরস আহরণ প্রভৃতি কর্মে নিযুক্ত রশ্মিগণকে যে শক্তি পালন করে থাকেন তাঁরা দেবপত্নী নামে বা দেবী নামে অভিহিতা। এই দেবী শক্তি সেই ঐশী অদীনা অক্ষয়া মায়াশক্তি প্রজ্ঞা যিনি আত্মার সঙ্গে অবিভাগাপন্না, তাঁরই বিস্তার। এঁদের মধ্যে সরস্বতী, সূর্যা অগ্নায়ী, ইন্দ্রাণী, অশ্বিনীরাট্, রোদসী, বরুণানী প্রধানা। প্রতি ঋতুতে কালে কালে যে যজ্ঞকর্ম সাধিত হয় তাই ঋতুপথ সত্যপথ। এই ঋতকর্মের প্রজ্ঞাকর্মের পালিকা শক্তি দেবপত্নীগণ। আর অগ্নিই সেই ঋতুপথে সত্য পথে সকল্কে নিয়ে চলেন। সকল যজ্ঞকর্মই অগ্নি করেন, মানুষেরা সেই যজ্ঞের অনুকরণ করেন মিত্র। যজ্ঞের সামান্য অংশই যাজ্ঞিক মানুশ সমাধান করতে পারেন। তবে যিনি অগ্নির ঋতকর্মের সত্যকর্মের সঙ্গে ভাবনার দ্বারা মননের দ্বারা একাত্ম হয়ে যান তাঁকে অগ্নি সঠিক পথে নিয়ে যান। তখন অগ্নির সঙ্গে সাধকের সখ্যতা হয়। এই যে অগ্নির স্বরূপ রশ্মিগণ যাঁরা নিত্য আমাদের ঘিরে আছেন, তারা শ্রবণসমর্থ, কর্মসমর্থ, প্রজ্ঞাযুক্ত নিরাকার চৈতন্য। এঁরাই অগ্নির দূতস্বরূপ, এঁরাই জানতে পারেন আমাদের মনোবাসনা কামনা। যা সত্য, যা ঋত, যা উন্নত, তা সকলই এঁদের অধীন। রশ্মির সঙ্গে সখ্যতাই দেবগণের সঙ্গে সখ্যতা তথা আত্মার সঙ্গে সখ্যতা। এই সখ্যতার দ্বারাই সর্বসিদ্ধি লাভ হয় আর এই দেবরশ্মিগণই আমাদের কুকর্ম থেকে নিবৃত্ত করে সত্যপথে নিয়ে চলেন। এঁরা এই কর্মে অতন্দ্র, অনলস। যদিও আমরা ভুল করি তথাপি এঁরা আমাদের সঠিক পথে নিয়ে যাবার জন্যই অপেক্ষা করেন। যখন কুকর্ম আর পাপ আমাদের মধ্যে প্রবল হয় ওঠে তখন এঁরা সেই পাপকে ধ্বংস করতে গিয়ে হয়তো আমাদেরও ধ্বংস করেন কিন্তু তার সকল কিছুতে জ্যোতিতে পরিণত করেন, কারণ জ্যোতিই সত্য ও পরম। এই ধ্বংসকর্ম যখন তাঁরা করেন, তখন পাপরূপ শত্রুকে দুঃখসন্তপ্ত করেন তখন তাঁরা রুদ্ররূপেই এই কর্ম করেন এবং কর্ম করার সময় নিজেরাও রোদন করেন; কারণ অগ্নির সকল কর্মই যে অহিংসিত কর্ম, তাঁর সকল যজ্ঞই অহিংসা। তিনি ভয়ঙ্কর হলেও করুণাসিন্ধু।  এই তাঁর প্রকৃত রূপ।
এই যে পরমাত্মা অগ্নি যিনি এক হয়েও প্রভূত ঐশ্বর্যবলে বহুনামে বহুরূপে স্তুত সেই পরমাত্মারই অঙ্গস্বরূপ অন্য দেবগণ। দেবতারা পরস্পর ভিন্ন এবং তাঁদের স্তুতিও পৃথক কারণ তাঁদের নাম ভিন্ন, কার্যও ভিন্ন। একই ব্যক্তি যেমন কখনও পিতা কখনও স্বামী কখনও বন্ধু, দেবতাদের কার্যও সেরূপ। দেবতাদের সংখ্যা বহু হলেও তাঁরা পৃথিবী, অন্তরিক্ষ ও দ্যুলোক – এই তিন স্থান ব্যাপ্ত করে বর্তমান আছেন। প্রকৃতপক্ষে অগ্নিই পরমাত্মা, বহুরূপে শ্রুত এবং সর্বদেবতা, যিনি ত্রিলোকব্যাপী। এই পৃথিবীর মানুষ, পশু, পক্ষী এবং আর সকল জীব ও অজীব যেমন পৃথিবীতে বাসকারী বলে ‘পার্থিব’ নামে পরিগণিত হতে পারে তেমনি দেবগণও তিনলোকের সম্যক্ পালনের দ্বারা ‘এক’ বলে পরিগণিত হতে পারেন। লৌকিক দৃষ্টান্তে এই ভেদাভেদ নর এবং রাষ্ট্রের মত।
সুতরাং কার্যসাধনের জন্য সেই এক পরম অগ্নি সূর্যরূপে জাত হলেন আর সূর্য হলেন তাঁর স্বীয় মণ্ডলের সম্রাট। তাঁর সাম্রাজ্যকে তিন প্রধান ভাগে ভাগ করে পরমাত্মা অগ্নির উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য তিনি নিরন্তর বাধ্যতামূলক কর্মে নিজে প্রবৃত্ত থেকে স্বীয় সাম্রাজ্যের সকলকেও সেই কর্মে নিযুক্ত করলেন। দ্যুলোকে তিনি রইলেন সূর্যরূপে; আকাশ ছাড়া কোন বলকার্য সম্ভব নয়। তাই কাকাশকে সকল বলকার্য সাধনের জন্য নিযুক্ত রেখে সেই আকাশে বজ্র বিদ্যুৎ বায়ু প্রভৃতিকে ইন্দ্র নামে পরিচিত করলেন। এই যা কিছু বলকার্য অন্তরিক্ষে, এবং এই পৃথিবীতে দেখা যায় তা সর্বই ইন্দ্রকর্ম। এমন কি অতি ক্ষুদ্র প্রাণীর কর্ম ও বলকর্ম বা ইন্দ্রকর্ম। আর সেই পরম অগ্নি এই পৃথিবীতে অগ্নিরূপে নিজেকে নিযুক্ত করলেন সর্বকর্মারূপে, বিশ্বের সকল অগ্নির সঙ্গে সন্বন্ধ রাখার জন্য। ঐ দূরে বহুদূরে দূরতম প্রদেশে, চিন্তার অনধিগম্য প্রদেশে যিনি অগ্নিরূপে বর্তমান, তিনিই এই পৃথিবীতেও অগ্নিরূপে বর্তমান। তিনি সেখানেও যা, এখানেও তা। সেই অগ্নিই এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার জন্য সূর্যের মধ্যে অবস্থান করলেন আত্মারূপে। জগতের আত্মা সূর্য তখন তাঁর রশ্মিদের সপ্তচ্ছন্দে ছন্দায়িত করে সপ্ত বায়ুস্তর ভেদ করে মানুষকে বিস্তীর্ণ সুজন্মা ভূমি প্রদানের ইচ্ছা করে পৃথিবী পরিক্রম করলেন। আমাদের উদার আশ্রয় দেবেন বলে রশ্মিগণকে নম্রভাবাপন্ন করে পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন; তা না হলে তার রশ্মির প্রখর তাপে পৃথিবী যে ঊষর ভূমিতে পরিণত হবে। তাই তিনি সৃষ্টির কারণে, আনন্দের কারণে পৃথিবীতে সূর্যরশ্মির দ্বারা বিনীতভাবে প্রবেশ করলেন। যাঁর পদ অন্তরিক্ষ পরমস্থানে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত, যিনি ছলরহিত, যিনি কাউকে হিংসা করেন না, যিনি চরাচর বিশ্বের রক্ষক সেই বিষ্ণু সূর্য তিনপাদের দ্বারা অর্থাৎ উত্তরায়ণ, দক্ষিণায়ন ও বিষুববিন্দু স্পর্শের দ্বারা বিশ্বভূবন পরিক্রমা করেন। আর এই ভাবে জগৎ পরিক্রমা করে তিনি সকল ধর্ম, সকল ব্রত, সকল কর্মকেই ধারণ করে থাকেন। আদিত্যের কর্ম দ্বাদশ প্রকার। তিনি উদয় ও অস্ত গমনের দ্বারা দিন ও রাত সৃষ্টি করে বার মাস, ছয় ঋতু ও সংবৎসর রচনা করেন। আদিত্যের কর্ম রশ্মিসহায়ে জলরস আকর্ষণ, রশ্মির দ্বারা রসধারন, আর যা কিছু প্রচ্ছাদন প্রকাশন তা সমস্তই আদিত্যের কর্ম।  আদিত্যের উদয়ে ভারত্রি ও গ্রহ নক্ষত্রের প্রচ্ছাদন বা অন্তর্ধান হয়; অবিদ্যা দূর করে আদিত্য জ্ঞানের প্রকাশ সাধন করেন। এই যে আদিত্য ইনি কখনও অস্তমিত হন না, উদিতও হন না। ইনি সর্বদা একরূপ। তাঁকে যখন অস্তমিত মনে করা হয় তখন তিনি সেই দেশে দিনের সমাপ্তি করে রাত্রি করেন ও অন্য দেশে দিন করেন। আবার সখন তাঁকে প্রাতঃকালে উদিত মনে করা হয় তখন তিনি সেই দেশে দিন করেন ও অন্য দেশে রাত্রি করেন। এই ঊষা ও রাত্রি যেন দুই ভগিনী। সন্ধ্যার আগমনে অরুণ যখন ধূসরবর্ণ প্রাপ্ত হন তখনই রাত্রির আরম্ভ। এই ধূসরবর্ণা রাত্রি শ্যাবী নাম ধারণ করেন। ক্রমে রাত্রির রূপ পরিবর্তিত হতে থাকে। প্রথম রাত্রিকাল পর্যন্ত তিনি দোষারূপিণী, মধ্যরাত্রিতে তমস্বতী; আর নক্তারূপে রাত্রি অব্যক্তবর্ণা। তখন তিনি ব্যক্তবর্ণ দিনের বিপরীতরূপ এবং হিমবিন্দুর দ্বারা জগৎ সিক্ত করেন। তিনি ঊধঃরূপে স্নেহরস প্রদান করেন, বস্বীরূপে ভগিনী ঊষার আগমনের পথ করে দেন। জ্যোতিঃসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এই ঊষা তখন বিচিত্র প্রকাশভঙ্গীতে অতি বিস্তারের সঙ্গে জন্মলাভ করেন। এই নক্ষত্রখচিত রাত্রিদেবী যেন ময়ূরপুচ্ছধারিণী, নিদ্রারূপ মায়াজাল বিস্তারে পাশহস্তা। রাত্রির আগমনে জনপদসমূহ নিস্তব্ধ, বিহঙ্গরা নীড়াশ্রয়ে সুখে বাস করে, পথচারী ও শ্যেন সকলেই শয়ন করে। রাত্রির অন্ধকার যেন ঋণের মত সর্বদা আচ্ছন্ন করে রাখে। ঊষার আগমনে ঋণের মত কৃষ্ণা রাত্রি দূরে চলে যান। রাত্রির শেষরূপ ‘বস্বী’ যখন ধনভারে অবনতা হয়ে ঊষার আগমনের পথ করে দিয়ে অন্তর্হিতা হন তখন ধনবতী ঊষা বিচিত্র ভঙ্গীতে তাঁর জ্যোতিকে অতি বিস্তীর্ণ করেন। ঊষা দেবী ভগিনী রাত্রিকে জ্যোতির দ্বারা অপাবৃত করে তমস্যার পারে দাঁড়িয়ে নিজে নিজেই হাসতে থাকেন। নিয়ত রূপ-পরিবর্তনকারিণী ঊষা ও রাত্রি কখনও স্থির হয়ে অবস্থান করেন না। সকল বস্তুর উৎপাদনকারিণী রাত্রি ও ঊষা ভিন্নরূপা হলেও সমানমনা; একে অপরকে বাধা দেন না। একে অন্যের বর্ণ বিনাশ করেন না, একে অন্যের পরে আগমণ করেন। পার্থিব ধনের ঈশ্বরী ঊষা কাউকে ধনের জন্য, কাউকে অন্নের জন্য, কাউকে যজ্ঞের জন্য, কাউকে বা অভীষ্টলাভের জন্য জাগরিত করেন। ভুবনপ্রকাশিকা ঊষা সকলের জীবনের উপায়। এই অহোরাত্রই জ্যোতি দ্বারা দিনকে এবং হিমের দ্বারা রাত্রিকে পরিব্যাপ্ত করেন। এই অহোরাত্রই দেশ ও কালে পরিব্যাপ্ত। এই কাল গতিযুক্ত, নমনীয়, দর্শনীয়, ধ্বংসকারী ও শব্দকারী। কাল-ই শস্য উৎপন্ন করে ও ভোজন করে; কাল-ই অতি প্রসারিত ক্ষিপ্রহস্তযুক্ত; কাল-ই কল্যাণকারী, বহুভোজী। এই বুদ্ধি নিহিত; কাল-ই বহুকর্মকারী, অপ্রতিহতগতি, শত্রুক্ষয়কারী, রোগনাশকারী, মিথ্যারহিত, শত্রুরোদনকারক, আবার কালই স্বয়ং রোদনকারী। এই কালের গতিচক্র সদা সচল থাকে বৃষ্টি সম্পাদনের দ্বারা, অমৃতবারি বর্ষণের দ্বারা, যা একধনা, যা পেলে মানুষ বাঁচে, শস্য উৎপন্ন হয়, সংসার চক্র নিজ নিয়মে চলতে থাকে। এই বৃষ্টিসম্পাদন, মেঘবিদারণ ও যা কিছু বলকার্য তা সমস্তই ইন্দ্রকর্ম। এমন কি কীটপতঙ্গাদির দ্বারা যে বলকর্ম সাধিত হয় তা সমস্তই ইন্দ্রকর্ম, কারণ বলই প্রাণ, প্রাণই বায়ু, বায়ুই ইন্দ্র। আদিত্য যে রসধারা আকর্ষণ করেন, সেই অমৃতবারিকে ইন্দ্র লোকপালনের জন্য বৃষ্টিধারারূপে বর্ষণ করেন। এই আদিত্য বিষ্ণু সত্যধর্ম ধারণ করতে করতে কর্মসমূহ সৃষ্টি করেন, যে কর্মসমূহের দ্বারা সঙ্কল্প ইচ্ছাশক্তি আজ্ঞা শাসন মর্যাদা নিয়ম বশ্যতা সেবাবৃত্ত ও অধিকার ঐশ্বর্য ও আধিপত্যরূপ ব্রতধর্ম কর্ম সকল রচিত হয়। তাঁর এই ব্রতকর্ম হতে মানুষেরা জীবনধারণপ্রণালী, আচার, ব্যবহার, ধর্মীয় শাসনের প্রতি প্রষস্ত অনুরাগ, তপস্যাজনিত কৃচ্ছ্রতা, পবিত্র ব্রতবদ্ধ জীবনের অভ্যাস করে তাঁর কাছ থেকে মানুষ অনলস অতন্দ্র কর্ম শেখে যে কর্ম জীবের সকল কামনা পূরণ করে। যে আদিত্যরূপী বিষ্ণু দ্যুলোকে দূরতম প্রদেশে অতি উত্তম স্থানে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থেকে সকল কর্ম ধারণ করে জগৎ পালন করেন, তাঁকে ঘিরেই রয়েছে বিশ্বের সকল জ্ঞান। এই জ্ঞান গুণগত বিচারে ঋক্, সাম, যজু, ও অথর্ববেদ এই চার ভাগে বিভক্ত। এই জ্ঞানসমূহ আদিত্যদেবের কিরণরাশিকে আশ্রয় করে রেয়েছে; এরা যেন কিরণরাশির মধুনাড়ীসমূহের মধুকরবৃন্দ। এই কিরণরাশি নিখিল জ্ঞনকে আশ্রয় করে লোহিত, শূভ্র, কৃষ্ণ ও অতিকৃষ্ণচ্ছটা ধারণ করে যথাক্রমে ঋক্, যজু, সাম ও অথর্ববেদ নামে অভিহিত হয়। পূর্বে যে তিন লোকের কথা বলা হয়েছে সেই তিন লোক – অ, উ, ম, এই তিন অক্ষরাত্মক নামেও পরিচিত। অ = পৃথিবী। উ = অন্তরিক্ষ। ম = দ্যুলোক। অ + উ + ম = ওম্। ওম্ শব্দের দ্বারা পূর্ণ ব্রহ্মকেই বোঝান হয়েছে; এই তিন লোকের অতিরিক্ত যে জগৎ যা মানুষের বাক্য ও মনের অগোচর তাও ওঙ্কার; এবং যেহেতু সূর্যের মধ্যে পরমাত্মার প্রকাশ সেহেতু ওম্ শব্দে ত্রিলোকব্যাপী জগতের আত্মা সূর্যের অধিষ্ঠানকেও বোঝায়। এই আদিত্য সূর্য নীলাতিগ কৃষ্ণচ্ছটা থেকে দীপ্তিলাভ করে ‘ওম্’ উচ্চারণের দ্বারা আকাশ পথে বিচরণ করেন। আর তিনি এইভাবে ঋতের ছন্দে বলতে বলতে উদক, ধন ও সত্য সৃষ্টি করেন; আর সকল কর্মকে স্পর্শ করে আতিক্রান্ত হন। তাঁর এই সকল কর্মঈ ঋত এবং তিনিই ঋতদেব। এই প্রত্যক্ষ দেবতা সূর্য নর বা পুরুষাকৃতি নন বলে অপুরুষব্ধি। ইনি হস্তপদবিহীন, ইনি চলেন, অথচ চলেন না; আর এঁকে ঘিরেই নিখিল বেদ বা জ্ঞান বর্তমান। ইনি নিত্য, কতকাল ধরে উদিত হচ্ছেন, কতকাল ধরে উদিত হবেন তা কেউ জানে না। নিত্য বলেই ইনি যুগে যুগে কবি জ্ঞানী ঋষিদের আলোচনার বিষয়। সূর্য বলে বেদও নিত্য ও অপৌরুষেয় কারণ অপুরুষবিধ সূর্যকেই আশ্রয় করে রয়েছে ঋক্, যজু, সাম ও অথর্ববেদের সকল জ্ঞান। বেদে যত কিছু ভাবনা রয়েছে তা সকলেই বীজাকারে। বেদতত্ত্ব বোঝবার জন্য ষড়বেদাঙ্গ – শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দঃ ও জ্যোতিষ। তার বেদতত্ত্বকে বিস্তৃত আকারে কাব্যরয়াশ্রিত সাহিত্যের মাধ্যমে যুগে যুগে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য লেখা হয়েছে পুরাণগুলি। সূর্য নিত্যবলে যেমন সকল কালেই সূর্যসংক্রান্ত আলোচনা হয়ে থাকে এবং আজও হয়, তেমনি বেদ সূর্য আশ্রিত বলে সকল কালেই বেদের তত্ত্ব নিরুপণ হয়ে থাকে তেবং আজও হয়।
এই আদিত্য সূর্যের পরমপদে যে মধুর উৎস সেই মধুই ধর্ম। এই ধর্ম বায়ুতে, নদীতে, ওষধিতে, দিবারাত্রিতে, পৃথিবীর ধূলায়, দ্যুলোকে, বনস্পতিতে, কিরণরাশিতে সর্বত্র মধুর মধুররূপে প্রবাহিত হয়ে সকল কিছুই মধুময় করে তোলে। এই ধর্ম সর্বভূতের মধু, সর্বভূত এই ধর্মের মধু। যিনি এই ধর্মে তেজোময় অমৃতময় পুরুষ তিনিই এই আত্মা এই অমৃত এই ব্রহ্ম এই সব। বিজ্ঞান যাঁর সারথি, মন যার সুনিয়ন্ত্রিত, তিনি যে পথের পারের সন্ধান পান তাই আদিত্য বিষ্ণুর পরম পদ। সমস্ত জীবের প্রতি দয়া ক্ষমা শান্তি অহিংসা সত্য ঋজুতা অদ্রোহ অনভিমান লজ্জা তিতিক্ষা ও শম – এই সকলই পরম ব্রহ্মকে লাভের পন্থা। আর সূর্যরূপী জগতের আত্মার প্রতি মনোনিবেশ করে বিদ্বান ব্যক্তি কর্মকে নিশ্চিতরূপে জেনে সেই পরম তত্ত্বকে সম্যক্ দীপ্তি করেন।
পুর্বে যে কথা বলা হয়েছে, ত্রিমাত্রাত্মক ‘ওম্’ এই অক্ষররূপ প্রতীকের দ্বারা সুর্যমন্ডস্থ পরম্পরুষকে বোঝাচ্ছে, সেই ওঙ্কার অবলম্বনেই বেদবিদ্যাবিহিত কর্ম করে হয়, ওম্ উচ্চারণ করে দেবতাদের শ্রবণ করে হয়, ওম্ উচ্চারণ করে স্তোত্রপাঠ ও সাম গান করা হয়। ওম্ এই অক্ষরের পূজার জন্য সাধকের জীবনের সঙ্গে মনমের দ্বারা এই অক্ষর ব্রহ্মকে মিলিত করার জন্য ওম্ এই অক্ষরের নিজ মহিমার দ্বারা এবং এই ওম্ অক্ষরের পরিণামভূত অন্ন-জল প্রভৃতির রস হতে নিষ্পন্ন হবির দ্বারা এই ওম্ অক্ষরের উদ্দেশ্যই পূজা করা হয়। যিনি অঙ্কারূপ অক্ষরকে এইভাবে জানেন এবং যিনি তা’ জানেন না, তাঁরা উভয়েই এই অক্ষরব্রহ্মে অবস্থিত থেকে সকল কর্ম করে থাকেন বটে, কিন্তু যিনি ওঙ্কাররূপে অক্ষর বিজ্ঞান জানেন ও শ্রদ্ধাসহকারে উপাসনাতি করেন তিনি অধিক ফললাভ করেন। যিনি অক্ষর ব্রহ্মকে লাভ করতে চান তিনি ‘ওম্’ উচ্চারণের দ্বারাই লাভ করেন। কারণ ওঙ্কারই ধনু, জীবাত্মা শর, এবং ব্রহ্ম সেই শরের লক্ষ্য। সাধক প্রমাদহীন হয়ে লক্ষ্য ভেদ করে লক্ষ্যের সঙ্গে অভিন্ন হন। অজ্ঞানরূপ অন্ধকারের অতীত পরপারে যাবার জন্য ওঙ্কার-ই অবলম্বন।
যা শব্দ করে তা স্বর; আর সূর্য ‘ওম্’ শব্দ করে ভ্রমণ করেন বলে সূর্য-ই ‘স্বর’। সুতরাং এই ‘ওম্’ অক্ষরও ‘স্বর’, এবং এই ওঙ্কার-ই অমর ও অভয়। এই ওঙ্কার প্রবেশ করে দেবরশ্মিগণও অমর হন।
পূর্বে যে বলা হয়েছে, ওম্ উচ্চারণ করে সামগান করে হয়, সেই সামগান সূর্যকে ঘিরে হয়। সা = প্রকৃতি বা অদীনা অক্ষয়া ঐশীশক্তি; অম্ = আত্মা, যা সূর্য-মণ্ডলের মধ্যে আসীন। সুতরাং সূর্যরূপ জগতের আত্মার সঙ্গে যা ওতপ্রোত তা ‘সাম’। আর যেহেতু ঋক্মন্ত্রের দ্বারা সামগান করা হয় সেহেতু ঋক্-ই সাম, এবং সাম-ই সূর্য। আর, যেহেতু সূর্যই সাম ও অঙ্কার, এবং সূর্যই প্রাণরূপে প্রতিষ্ঠিত সুতরাং প্রাণও ‘ওম্’ উচ্চারণ করে এই জীবদেহেই বিভরণ করে। আর যেহেতু পৃথিবী, দ্যুলোক ও অন্তরিক্ষলোক পরস্পর সন্বন্ধযুক্ত ও একাত্ম, সুতরাং অঙ্কাররূপ সামসঙ্গীত যা সূর্যইসঙ্গীত তা সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত। চরাচর ভূতবর্গ ঊর্ধ্বে অবস্থিত আদিত্য সূর্যেরই স্তব করে থাকেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সামের আশ্রয় ‘স্বর'; স্বরের আশ্রয় ‘প্রাণ'; প্রাণের আশ্রয় ‘অন্ন'; অন্নের আশ্রয় ‘জল'; জলের আশ্রয় পুনরায় ‘স্বর’ বা আদিত্য সূর্য, যাঁকে ঘিরে জল সদা বর্তমান। সুতরাং স্বর বা স্বরলোকের অথবা স্বর্গলোকের অতীত আশ্রয়ান্তের আমাদের কেউ নিয়ে যেতে পারে না। যে সূর্যকে ঘিরে জল সদা বর্তমান সেই জলরাশি অন্তরিক্ষে বিচরণ করে, মেঘগর্জন করে জল দান করে, যা হতে সর্বভূত জাত হয়। অন্তরিক্ষে অবস্থিত এই মেঘগর্জনই বাক্ বা বাক্যরূপে অধিষ্ঠিত, যা বৃষ্টি জল সৃষ্টি করে শব্দ করে। এক বাক্ হতে মেঘ বারিবর্ষণ করে, বাক্ হতে চতুর্দিকে আশ্রিত সর্ববস্তু জাত হয়, বাক্ বা শব্দ হতে অক্ষর সৃষ্টি হয়, এবং এই বাক্-ই বিশ্বের উপজীব্য। এই বাক্ই বিশ্বরূপ সকল উয়ব উচ্চারণ করে; এবং বেদবাক্য ও অন্যান্য লৌকিক বাক্য সকলই এই অন্তরিকশে অবস্থিত মেঘগর্জনরূপ শব্দেরই বাক্ রূপে বিস্তার। তাহলে আকাশরূপ ব্রহ্মই বাক্যের পরমস্থান। আর সমস্ত দেবরশ্মিগণই আকাশব্রহ্মে অবস্থিত বাক্যের বা শব্দের মধ্যে প্রবেশ করে আছেন। এই বাক্-ই অক্ষর বা অবিনাশী, আর তিরলোকাত্মক ‘ওম্’ এই অক্ষরও অবিনাশী। অতএব ‘ওম্’ এই অক্ষরই – এই সমস্ত। ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান – এই সকলি ওঙ্কার, এবং অপর যা কিছু ত্রিকালের অতীত তাহাও ওঙ্কার। এই সমস্তই ব্রহ্ম। যিনি সাধক তিনি যদি এই সমস্ত জেনে তিনলোকের ভাবনাকে একত্রে সম্মিলিত করেন তবে ওঙ্কাররূপে প্রতীক অবলম্বনের দ্বারা যা শান্ত, অজর, অমৃত, অভয় ও সর্বোত্তম তা প্রাপ্ত হন। সর্প যেমন জীর্ণ ত্বক-মুক্ত হয়, সাধকও তেমনি ত্রিমাত্রাত্মক ওঙ্কাররূপ সামের দ্বারা ঊর্ধ্বে হিরণ্যলোকে নীত হয়ে সূর্যের মধ্যে পরমপুরুষকে দর্শন করে।
যে আদিত্য সূর্য ব্যাপ্ত হয়ে বিষ্ণুরূপ ধারণ করে কিরণরাশির দ্বারা জগৎ উদভাষিত করেন, যিনি জ্ঞানরাশিকে ধারণ করেন, যিনি জ্ঞানপ্রকাশক বাক্যকে ধারণ করেন, সেই বিষ্ণুর ব্যাপকত্বই সর্বযজ্ঞস্বরূপত্ব। তাই ঋষি বলিয়াছেন, দেবকাম মানুষেরা যে পথ ধরে গমন করে আহ্লাদিত হন, আমিও যেন সেই পথ পাই। এই বিপুলগমণ বিষ্ণু আদিত্যের পরমপদে মধুর উৎসব। তিনিই আমাদের প্রকৃত বন্ধু।
আমাদের এই প্রকৃত বন্ধু সূর্য যেমন অন্ন-জল-আশ্রয় প্রভৃতির দাতা, তেমনি তিনি আমাদের অন্তরে আহ্লাদকর রসসৃষ্টির জন্য চন্দ্রকে ধারণ করেন। এই চন্দ্র যিনি আহ্লাদকর ভসের উৎস তিনি সোম নামেও অভিহিত। জলরূপ সোম যেমন প্রাণিমাত্রেরই আহ্লাদের কারণ, এই চন্দ্র সোমও তেমনি সকল প্রাণীর আহ্লাদের কারণ। এই সোমচন্দ্রের জন্য বিষ্ণু সূর্য মেঘের আগরণ উন্মোচন করে পৃথিবীতে চন্দ্রের স্নিগ্ধ কিরণরাশির প্রবেশের দাওর খুলে দেন। আর সকিল দেবরশ্মি সোমচন্দ্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে আনন্দলোকের ঐশ্বরিক আহ্লাদ বর্ধিত করেন। সূর্যের যে শোভন রশ্মি গোবৎ স্নিগ্ধ তা চন্দ্রে নমিত হয়ে চন্দ্রকে উজ্জ্বল করে। সূর্যের গো-রশ্মিকে ধারণ করেন বলে চন্দ্র ‘গন্ধর্ব’ নামেও পরিচিত। শরৎকালীন আকাশে চন্দ্রমার স্বিগ্ধ জ্যোৎস্নার স্পর্শে ঊর্ধ্বাকাশে শুভ্র ঘৃতবৎ মেধের নিরন্তর আনাগোনা যে স্বর্গীয় শোভা সৃষ্টি করে সেই ঐশ্বরিক আহ্লাদ আস্বাদন করেন কবি ও জ্ঞানী বিপ্রগণ। মানুষের মধ্যে যিনি সর্বধন ও সর্বভোগসম্পন্ন, যিনি অন্যের অধিপতি, সেই মানুষ মনুষ্যাসমাজে মনুষ্যনন্দের পরমানন্দের নিদর্শন। আর এই গন্ধর্ব বা চন্দ্রলোকের যে আনন্দ তা মনুষ্যলোকের সর্বোত্তম আনন্দের লক্ষণিত।
এতক্ষণ যা বলা হোল তা সবই ঋষিবাক্য। এই সূর্য, চন্দ্র, ও পৃথিবীকে ঘিরে প্রতি ঋতুতে ঋতুতে যে বিচিত্র পরিবর্তন সংঘটিত হয় এবং যা বারবার একই ভাবে আবর্তিত হতে থাকে তাকে লক্ষ্য করেই প্রতি ঋতুতে ভারতীয় জনজীবনে নানা উৎসব। এই উৎসবগুলি বিশ্বের সঙ্গে একাত্মভাবে অবস্থানের স্মারকমাত্র। ঋতুতে, ঋতুতে, কালে কালে সূর্যের ব্রতকর্মানুষ্ঠানেরই অনুকরণ বৈদিক যজ্ঞভূমিতে। সূর্যের উত্তরায়ণ শেষে পুনরায় দক্ষিণায়ন যাত্রার অনুকরণে রচিত উৎসব। আষাঢ় মাসে অম্বু বা বারিবর্ষণের সূচনাতে যখন পৃথিবী বীজধারণযোগ্যা হন, তখন হয় অম্বুবাচী উৎসব। বর্ষণশেষে বিশ্বকর্মা ও শারদীয় উৎসব। দক্ষিণায়ণে বর্ষণকালে দেবরশ্মিগণ যখন পিতারূপে জগৎপালনের জন্য বর্ষণকর্মে নিযুক্ত থাকেন তখন পিতৃযজ্ঞ উৎসব। সূর্য পুরুষ বা আত্মা এবং সূর্যকিরণরাশি স্ত্রী বা পালিকা শক্তি। তাই সূর্যের এক নাম গোপা আর কিরণরাশি গোপিগণ। এই সূর্যকে মন্ডলাকার ঘিরে কিরণরাশির নৃত্যই রাসলীলা। আরভ যেহেতু রাসলীলা আহ্লাদজনক তাই পূর্ণিমার স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায় রাস উৎসব। প্রতি সংক্রান্তিতে, সৌর ও চান্দ্রমাসে, পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় এবং বিশেষ বিশেষ তিথিতে ভারতীয় জনজীবনে বিভিন্ন সমাজে যে উৎসব তা সকলই সূর্য ও চন্দ্রকে ঘিরে। ভারতীয় সমাজ ধর্ম দর্শন সাহিত্য পুরাণ স্মৃতিশাস্ত্র সকলই বেদের প্রভাবে প্রভাবান্বিত। ভারতীয় বিবাহ পদ্ধতি, আচার ব্যবহার, রীতিনীতি, গার্হস্থ ধর্ম, বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, সঙ্গীতশাস্ত্র প্রভৃতি সকলই এই চার বেদের দ্বারা প্রভাবান্বিত যে বেদের প্রধান আলোচ্য বিষয় আত্মা ও সূর্য। বোইদিক দেবতা অপুরুষবিধ হলেও বিচিত্রলীলাকারী বলে নানা মূর্তী পরিগ্রহও করতে পারেন কিন্তু তাই বলে মূর্তরূপেই তাঁর পূজা করতে হবে বা তাঁকে ভাবনা করতে হবে এমন কথা বেদের কোথাও বলা হয়নি। বেদে এমন কথাও বলা হয়নি যে, বেদবিদ্যা বিশেষ শ্রেণীর কুক্ষিগত। বরং বলা হয়েছে চে, বেদে সকলেরই অধিকার। যে যেমন গুণের অধিকারী সে সেরূপ কর্ম করে সংসারে জীবন যাপন করবে, কৃপণের মত ধনসঞ্চয় করবে না। মেঘ যেমন জলদান না করে অন্ধকার সৃষ্টি করে কৃপণের মত জনসম্পদ নিরুদ্ধ করে রাখে এবং ইন্দ্ররূপী সূর্য বজ্রের আঘাতে সে অন্ধকার নাশ করে জলধারা সকলের জন্য দান করেন, এই দৃষ্টান্তকে অবলম্বন করে ঋষি বলছেন, মনুষ্য সমাজে যে কৃপণের মত ধনসঞ্চয় করে মনুষ্য সমাজের গতি নিরুদ্ধ করে মনুষ্যজীবনে অন্ধকার হতাশা সৃষ্টি করে, তাকে ইন্দের মত বলযুক্ত হয়ে আঘাত করে’ সকলের জীবনের গতির জন্য বারিরাশির ধনবন্টন করে দিতে হবে। গুণ অনুসারে কর্ম করার জন্যই চতুর্বর্ণের সৃষ্টি। ব্রাহ্মণের পুত্র ব্রহ্মবিদ্যার অধিকারী না হলে সে সেই অধিকার হতে স্বভাবিকভাবেই বঞ্চিত হয়। যিনি ব্রহ্মতত্ত্ব জেনে অগ্নির মত সমাজকে সুপথে নিয়ে চলেন তিনি যথার্থ ব্রাহ্মণ। যিনি শাসকরূপে অধিষ্ঠিত থেকে সমাজকে ক্ষত বা আঘাত থেকে রক্ষা করেন তিনি যথার্থ ক্ষত্রিয়। যিনি বিশে বিশে অর্থাৎ প্রতি জনের সঙ্গে সন্বন্ধ রেখে প্রতি জনের প্রয়োজনীয় দ্রব্য বন্টনের ব্যবস্থা করে নিজ প্রয়োজন মেটাবার জন্য পারিশ্রমিক রূপে সামান্যলাভে সন্তুষ্ট থাকেন তিনি যথার্থ বৈশ্য। যিনি কায়িক পরশ্রমের দ্বারা সেবামূলক কাজের দ্বারা নিজ অন্ন সংস্থান করে সন্তুষ্ট তিনিই যথার্থ শূদ্র। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এ ব্যবস্থা সর্বত্রই বর্তমান, যদি না এই ব্যবস্থার বিকৃতসাধনের দ্বারা সমাজকে বিষাক্ত করে হয়। ঋষিও তাই বলছেন, ওহে সোম, আমার মেয়ে যব ভাঙ্গে, আমার ভাই বাণিজ্য করে, আর আমি স্তোত্র পাঠ করি, সুতরাং তুমিও তোমার ধর্ম কর; ইন্দ্রের জন্য জলরূপে ক্ষরিত হও।  এইভাবে বেদের বিষয়কে জেনে ঋক্। যজু, সাম, অথর্ববেদকে যিনি জানেন, যিনি নিয়মিত বেদ অভ্যাস করেন তিনি ক্রমমুক্তির সন্ধান পান যা তাঁকে আনন্দ দান করে, যা তাঁকে পাপমুক্ত করে।