সোমবার, ২৭ জুলাই, ২০১৫

জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা ………..সুব্রতা রায় ত্রিবেদী



 

জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা ………..সুব্রতা রায় ত্রিবেদী

 
 
 
 
 
 
1 Vote


Probir Protim Roy's photo.
রথযাত্রা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি অন্যতম জনপ্রিয় উৎসব। বৈদিক সমাজে প্রথমে এ জাতীয় কোন উৎসবের প্রচলন ছিল না। স্নানযাত্রা, দোলযাত্রা, রথযাত্রা প্রভৃতি উৎসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল সমাজের অভিজাত শ্রেণীর ব্রাহ্মণ ও বৌদ্ধরা। সম্রাট অশোক এসবের বিরুদ্ধে অনুশাসনও জারি করেছিলেন। কিন্তু কোন অনুশাসনই লৌকিক ধর্মের এ প্রবাহকে প্রতিহত করতে পারেনি।
গ্রিক, মিসরীয় ও ভারতীয় সভ্যতায় সপ্তাশ্ববাহী সূর্য প্রধান দেবতা এবং অন্যান্য দেবতা তারই রূপানত্মর। প্রাচীন হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্র মতে, পৃথিবী সূর্যের প্রদৰিণের সূত্রই রথযাত্রা এবং এই রথযাত্রাই নববর্ষের ইঙ্গিত বহন করে।
আচার্য রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদীর মতে, “দিবাকরের রথচক্র মহাকালের পদাঙ্ক অনুসরণ করিতেছে। উত্তর হইতে দৰিণে, দৰিণ হইতে উত্তরে তাহার রথচক্র প্রবর্তিত হইয়া মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর, মহাকাল দেহে অঙ্কিত করিয়া চলিতেছে।’ অতএব রথযাত্রা সূর্যের উত্তরায়ণের পর দৰিণায়ণ, দৰিণায়ণের পর উত্তরায়ণ, যাত্রার পর পুনর্যাত্রা, জগন্নাথের রথযাত্রা হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রাচীনতম সভ্যতার অবিমিশ্র বিভিন্নমুখী ধারারই সমন্বয়।
রথযাত্রা হিন্দুদের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাণের উৎসব। মিলনের এক মহামেলা। বর্ষাঋতুর আগমনের শুরুতেই এই উৎসব গ্রামে-গঞ্জে নগরে বিপুলভাবে সর্বজনীন রূপ নেয়। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে বর্ষাবিধুর আবহাওয়ার মধ্যেও বহুস্থানে মেলা বসে। বিপুল জনসমাগম ঘটে।
সাধারণত, রথযাত্রা বলতে আমরা আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়াতে অনুষ্ঠিত শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রাই বুঝি_ যদিও অন্য দেবতাদেরও রথযাত্রা আছে। জৈন ও বৌদ্ধদেরও এক সময় রথযাত্রা ছিল।
রথযাত্রার মূলে রয়েছে বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব। কালের পরিক্রমায় হিন্দু সভ্যতার উত্থানকালে এ রথযাত্রা ‘শ্রী জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা’ হিসেবে বিবর্তিত হয়েছে। এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
শ্রী জগন্নাথ আসলে ভগবান বিষ্ণুরই অবতার। অনেকের মতে, শ্রী জগন্নাথের এই মূর্তিরূপ শ্রী ভগবানের অসম্পূর্ণ রূপেরই প্রতিচ্ছবি। কারও কারও মতে, এই অসমাপ্ত, অসম্পূর্ণ মূর্তি নিরাকার ব্রহ্মারই প্রতিরূপ। আবার কারও কারও মতে, এ ত্রিমূর্তি বৌদ্ধ ত্রি-রত্নের প্রতীক। ধর্মমঙ্গল সাহিত্যে শ্রী জগন্নাথ ত্রি-রত্নের প্রথম রত্ন হিসেবে আখ্যায়িত। পরে অবশ্য হিন্দু পুরাণাদিতে নবম অবতার হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন। ওড়িশার লোকগীতিতে আমরা শ্রী জগন্নাথ ও বুদ্ধদেবকে অভিন্ন মূর্তিতে দেখতে পাই। এঁদের অবলম্বন করে অনেক লোককাহিনী প্রচলিত আছে।
এই রথ উৎসব পুরীর শ্রী জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকেন্দ্রিক উৎসব। শ্রী জগন্নাথ ও বিষ্ণু অভিন্ন। শুধু রূপভেদ মাত্র। ওড়িশার পুরীর জগন্নাথ ধামের রথযাত্রা জগদ্বিখ্যাত। পুরীর শ্রী জগন্নাথ সারা ভারতবর্ষেই পূজিত। জ্যৈষ্ঠে স্নান-যাত্রায় ও আষাঢ়ে রথের সময় বিশেষ জাঁকজমকের সঙ্গে পূজিত হন।
এই উৎসব আষাঢ়ের শুক্লা দ্বিতীয়াতে সম্পন্ন হয়। এদিন শ্রী জগন্নাথ ও বলরাম, স্নান সমাপন শেষে নূতন রথে আসীন হয়ে এক মাইল দূরে বৃৰলতাদি শোভিত উদাম গৃহে গমন করেন। এখানে সাতদিন অবস্থান শেষে আবার স্বস্থানে প্রত্যাগমন করেন। এটাই পুনর্যাত্রা বা উল্টোরথ। এ বছর আমাদের ১৯ আষাঢ়, ৩ জুলাই রথযাত্রা উৎসব অনুষ্ঠিত হবে। আবার ২৭ আষাঢ়, ১১ জুলাই উল্টোরথ পালিত হবে।
চৈতন্য মহাপ্রভুই মূলত নীলাচলে ভক্তিবাদের প্রবর্তন করেছিলেন। তিনি ছিলেন শ্রীকৃষ্ণের অবতার। তাঁর প্রেম, ভক্তি ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’_ এসব মূলমন্ত্রই তাঁর জীবন-দর্শন। জগন্নাথও তাই। মহাপ্রভুর জীবন-দর্শন শ্রী জগন্নাথের জীবন-দর্শন মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। তাই তো পুরীকে বলা হয় বৈষ্ণবের ধাম। মহাপ্রভুর ভক্তিবাদ, সার্বজীবে সমদৃষ্টি পুরীধামে মহাপ্রভুকে এত জনপ্রিয় এত কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত করেছে।
এই ধাম রাধা-কৃষ্ণের রূপক মহিমা গীত হয়ে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। রাধা-কৃষ্ণকে অবলম্বন করে রচিত বৈষ্ণব কবিতা মূলত ভক্তিমূলক গীতি কবিতা। তবে শাশ্বত মানব-হৃদয়ের আকুল আর্তি, বিরহ, প্রেম সুন্দর রূপ লাভ করেছে। বৈষ্ণব কবিতায় হৃদয়ের ব্যাকুলতা, ভালবাসার যে আর্তি তা দেখে রবীন্দ্র কবি চিত্তে চিরনত্মন প্রশ্ন_
“সত্য করে কহো মোরে হে বৈষ্ণব কবি,
কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমচ্ছবি
কোথা তুমি শিখেছিলে এই প্রেমগান
বিরহ-তাপিত। হেরি কাহার নয়ান
রাধিকার অশ্রম্ন-অাঁখি পড়েছিল মনে?”
বৈষ্ণব কবিতা আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। চৈতন্য দেবের শুভ-আর্বিভাব না হলে হয়ত বৈষ্ণব পদাবলীর এই ঐশ্বর্য থেকে আমরা বঞ্চিত হতাম। রাধাকৃষ্ণের প্রণয় লীলা শুধুই রোমান্টিসিজম নয়। গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সাধনা, তত্ত্ব এতে মূর্ত হয়ে উঠেছে। বৈষ্ণব কবিতা বাংলার নিজস্ব সম্পদ। ভাব, ভাষা ও ব্যঞ্জনায় অপূর্ব সৃষ্টি।
বাংলাদেশের অনেক স্থানের নাম ‘রথখোলা’ ও ‘রথবিহার’ নামে পরিচিত এবং এসব স্থান ও মন্দিরে আখড়ায় রথ-উৎসব পালন করা হয়। ঢাকা জেলার ধামরাই গ্রামে যশোমাধবের সুবিখ্যাত রথযাত্রা উপলৰে বিরাট মেলার সমাবেশ হয়।
কুমিলস্না শহরের জগন্নাথ বাড়ির রথযাত্রা বিখ্যাত। অতি শৈশবে সেখানে রথের মেলা ও উৎসবের ঘনঘটা দেখেছি। শ্রী চৈতন্য দেব ব্যাপকভাবে রথযাত্রা উৎসবের প্রচলন করেছিলেন। শ্রী প্রভুপাদ বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে সুদূর ইউরোপ ও আমেরিকায় এর প্রচলন করেন।
ঢাকায় নারিন্দায় ইসকনের রথের উৎসব ও শোভাযাত্রা মিছিল, তাঁতী বাজারে শ্রী জগন্নাথ জিউ মন্দিরের উৎসব ও মেলা সবিশেষ উলেস্নখযোগ্য। তাছাড়া সিলেট, যশোর, পাবনা, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম প্রভৃতি স্থানে এ উপলৰে মেলা ও উৎসরের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
রথযাত্রা আমাদের এক প্রাণের উৎসব। মিলনের এক মহামেলা। এই মেলা বাঙালীর ঐতিহ্য। সে কারণে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে এই রথ-উৎসবে সবাই যোগদান করে থাকে।

শনিবার, ২৫ জুলাই, ২০১৫

গীতগোবিন্দ বামন রূপ



 গীতগোবিন্দ 

ছলয়সি বিক্রমণে বলিমতভুত বামন ।

পদ নখ নীর জনিত জন পাবন ।।

কেশব ধৃত বামন রূপ জয় জগদিশ হরে ।।

সোমবার, ২০ জুলাই, ২০১৫

মা লক্ষ্মী




     
   
  দেবী লক্ষ্মী হলেন ধন সম্পদের দেবী। আদিশক্তির রাজসিক স্বরূপ । অগ্নি পুরাণ মতে শ্রী বা লক্ষ্মী হলেন যজ্ঞবিদ্যা , তিনিই আত্ম্যবিদ্যা , যাবতীয় গুহ্যবিদ্যা ও মহাবিদ্যা ও তিনি –‘যজ্ঞবিদ্যা মহাবিদ্যা গুহ্যবিদ্যা চ শোভনা ।আত্ম্যবিদ্যা চ দেবি বিমুক্তিফলদায়িনী ।।’ দেবী ভাগবত মতে যে স্বর্গে তিনিই স্বর্গ লক্ষ্মী , রাজগৃহে তিনি রাজলক্ষ্মী , গৃহে তিনি গৃহলক্ষ্মী । তিনি শান্তা , দান্তা , সুশীলা , সর্ব মঙ্গলা , ষড়রিপু বর্জিতা ।
পুরানে আছে সাগর মন্থন কালে দেবী লক্ষ্মী সমুদ্র থেকে প্রকট হন । সাগর হল লক্ষ্মী দেবীর পিতা । সাগরেই মুক্তা , প্রবাল আদি রত্ন পাওয়া যায় । রত্ন হল ধন , যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন লক্ষ্মী । এই হল দেবী লক্ষ্মীর সামগ্রিক স্বরূপ । দশ মহাবিদ্যার দশম মহাবিদ্যা কমলা দেবী হলেন মা লক্ষ্মী। স্বতন্ত্র তন্ত্র নামকএক তন্ত্র শাস্ত্র মতে কোলাসুর নামক এক অসুরকে বধ করার জন্যই দেবী কমলার আবির্ভাব । বারাহী তন্ত্র মতে পুরাকালে প্রজাপতি ব্রহ্মা, ভগবান বিষ্ণু, ভগবান শিব এই কমলা দেবীকে পূজা করেন বলে কমলা মায়ের এক নাম ‘ত্রিপুরা’ ।
মা লক্ষ্মী কমল আসনে থাকেন। কমল হল সর্বাত্মক বিকাশের প্রতীক ।
এমন কথিত আছে মা লক্ষ্মী পদ্মা নদী রূপে বঙ্গদেশে প্রবাহিতা আবার গঙ্গা , গোদাবরী , কৃষ্ণা , সিন্ধু রুপে ইত্যাদি ভারতের বিভিন্ন নদির অববাহিকাতে শশ্য শ্যামলা করে তুলেছেন । তার জলে বঙ্গদেশ ও ভারতবর্ষের মৃত্তিকা হয়েছে উর্বরা , শস্যে ভরা । তিনি কৃষিজ লক্ষ্মী। লাঙ্গল কর্ষণ কালে লক্ষ্মী অবতার সীতা মায়ের আবির্ভাব । লাঙ্গল দিয়ে জমিতে হাল বয়ে জমি উর্বরা করে চাষাবাদ করলেই মাঠ ভরে উঠবে সোনালী ধানে। এদিক থেকে তিনি কৃষি লক্ষ্মী। তাই ভাদ্র মাসে,পৌষ মাসে কৃষি লক্মী পূজা হয় প্রায় ঘরে। খনিজ লক্ষ্মী বলে সোনার দ্রব্য বোঝায়। সোনাকে আমরা মা লক্ষ্মীর সাথে তুলনা দিয়ে থাকি। ঐশ্বর্যের আর এক উৎস সমুদ্র। পুরান বলে সাগর মন্থন কালেই দেবী বিষ্ণুপ্রিয়ার আবির্ভাব। সাগরে ডুব দিয়ে প্রবাল, শঙ্খ, কড়ি আদি রত্ন সামগ্রী পাওয়া যায়। বানিজ্য করতেও দেখা যায় এই দেবীর আশীর্বাদের প্রসঙ্গ। নববর্ষে দোকানে ব্যবসায়ী গণ গণেশের সহিত মা লক্ষ্মীর পূজো করেন । এছাড়া লক্ষ্মী পূজোতে কলা গাছের কান্ড দিয়ে নৌকা বানিয়ে পূজোতে দেওয়া হয়, তা বানিজ্য ও লক্ষ্মী ঘরে আনারই প্রতীক। শ্রী রামচন্দ্র সীতা মাতা উদ্ধারের জন্য বা রাজা সুরথ রাজ্য উদ্ধারের জন্য এই মহালক্ষ্মী স্বরূপা দুর্গা দেবীর পূজা করেছিলেন। এই ভাবে লক্ষ্মী দেবীর একটি রূপ আমাদের সামনে ফুটে ওঠে ।
কোজাগোরী পূর্ণিমা বা শারদ পূর্ণিমাতে আমরা মা লক্ষ্মীর পূজো করি, যদিও দীপাবলি তেই সমগ্র দেশে পূজিতা হন। পূর্ণিমার চাঁদের আলো যখন দিগ দিগন্তে সন্ধ্যার কালো আঁধার কাটিয়ে আলোর ছটা ছড়িয়ে পড়ে, তখন উলু, শঙ্খ ধ্বনি সহকারে আমরা মা লক্ষ্মীর পূজার্চনা করি। এমন বলা হয়, দেবী জেগে খবর নেন- কে জেগে আছে –
নিশীথে বরদা লক্ষ্মীঃ জাগরত্তীতিভাষিণী ।
তস্মৈ বিত্তং প্রযচ্ছামি অক্ষৈঃ ক্রীড়াং করোতি যঃ ।।
কো জাগর্ত্তি – কে জেগে আছে ? কোজাগোরী শব্দের অর্থ এমন টাই । মা দ্বারে দ্বারে আশিষ দিয়ে যান, যে জেগে থাকে সে পায় আশিষ, কিন্তু যে ঘুমায় সে ঘুমিয়েই থাকে । আর অক্ষ ক্রীড়া মানে কিন্তু জুয়া খেলা নয়। ‘অক্ষ’ শব্দের অনেক প্রকার মানে হয় । এর মানে হয় ‘ক্রয় বিক্রয় চিন্তা’। বৈশ্য গণ এদিন জেগে ব্যবসা বানিজ্য করে ঘরে লক্ষ্মী আনার চিন্তা করেন। অক্ষ শব্দের আর এক মানে হয় জপ মালা। যারা সত্ত্ব গুনের তারা এই রাত্রি মায়ের নাম জপ করেই কাটাবেন। কো জাগর্ত্তি শব্দ তাদের কাছে আত্ম চৈতন্যের বানী। দেবীর বাহন হলেন পেঁচক। পেঁচক দিনে ঘুমায় রাতে জাগে। সাধারন মানুষ যখন ঘুমায়, পেঁচক জাগে। এ ঠিক যোগীর অবস্থা। সাধারন মানুষ যখন নিদ্রামগ্ন, যোগী তখন যোগ সাধনায়। পেঁচক ইঁদুর ভক্ষণ করে কৃষকের শস্য রক্ষা করে। এদিক থেকে এই প্রানীটি সত্যই আমাদের কাছে মা লক্ষ্মীর বার্তা, ভাব বয়ে আনে ।

শুক্রবার, ১০ জুলাই, ২০১৫

সামবেদ ভূমিকা





সামবেদ ভূমিকা  


‘বেদ’ শব্দটির সঙ্গে আমরা পরিচিত হলেও বেদ সন্বন্ধে আমাদের অজ্ঞতা পর্বত প্রমাণ। বেদ বিদ্যা দুইপ্রকার, পরাবিদ্যা ও অপরাবিদ্যা।
যে বিদ্যার চেয়ে শ্রেষ্ঠ বিদ্যা আর কিছু নেই, যে বিদ্যার সন্ধান পেলে আর কিছুই জানার বাকী থাকে না তা পরাবিদ্যা। কি সেই জ্ঞান যা জানলে পরে আর কিছুই জানার বাকী থাকে না? সে জ্ঞান বিশ্ব জ্ঞান। এই বিশ্বজ্ঞান কাকে আশ্রয় করে আছে? এই বিশ্বজ্ঞান স্বয়ং প্রকাশ। ইনি স্ব-ইচ্ছায় জাত হয়েছেন। ইনি স্ব-ইচ্ছায় কর্ম করে থাকেন। ইনি তাই আত্মজন্ম ও আত্মকর্মা। ইনি কখন জাত হলেন? ইনি যখন জাত হলেন তাঁর পূর্বে কি ছিল? ইনি যখন জাত হলেন তখন তাঁর পুর্বে তিনি ছিলেন সেই বস্তুর দ্বারা আচ্ছাদিত হয়ে যে বস্তুর অস্তিত্ব ছিল না আর সমস্ত কিছুই চিহ্ন বর্জিত ছিল। তখন যা নেই তাও ছিল না, যা আছে তাও ছিল না। তখন মৃত্যুও ছিল না, অমরত্বও ছিল না। রাত্রী ও দিনের প্রভেদ ছিল না। তখন কেবলমাত্র সেই বস্তু যিনি আত্মজন্ম, স্বয়ম্ভু আত্মা, তিনি বায়ুশূন্য প্রাণনক্রিয়া করছিলেন, আর তাঁর যে অবিদ্যমান বস্তু স্বীয় মায়া বা প্রজ্ঞা, তার সঙ্গে অবিভাগাপন্ন ছিলেন। তাই আত্মা ব্রহ্ম তখন সৎও ছিলেন না, অসৎও ছিলেন না। কেবলমাত্র স্বীয় মায়ার সঙ্গে অবিনাভাবে অতি ক্ষুদ্ররূপে, যার চেয়ে আর ক্ষুদ্র কিছু হয় না, সেইভাবে অবস্থান করে বায়ুশূন্য প্রাণনক্রিয়া সহায়ে নিজেই নিজের মায়া সহকারে নিজে নিজেই জ্বলছিলেন। তিনি আত্মজন্ম বলে তাঁর মায়ারূপ প্রজ্ঞা কর্মকে ইচ্ছা করলো। তখন তাঁর ইচ্ছাকে তিনি বর্ধিত করলেন, অবিনাভাব মায়াকে সঙ্গে নিয়ে। তিনি ঊর্ধ্বগতিযুক্ত হলেন। এই ঊর্ধ্বগতি হওয়ার ইচ্ছামাত্রই তাঁর প্রাণশক্তির বল বৃদ্ধি পেল। এই বৃদ্ধির ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে যেমন আকাশ সৃষ্টি হোল তাঁর বলকার্যকে ধারণ করার জন্য, তেমনি তাঁর বৃদ্ধি পাবার ইচ্ছা মাত্রই তিনি গতিযুক্ত হলেন। তিনি অগিযুক্ত বা গতিযুক্ত (অগি ধাতু গতি অর্থে) হয়ে তার বৃদ্ধিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকলেন। তাই তিনি হলেন ‘অগ্নি’। তাঁর এই বৃদ্ধি শিখাযুক্ত হোল গার তা হোল ঊর্ধ্বগতিযুক্ত। তিনি ছিলেন ‘দহর’ অতি ক্ষুদ্র, এখন হলেন ‘অগ্নি’ সব কিছুকেই এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য; বহন করবার জন্য; এবং সকলের আগে সকল কর্মে আগে আগে থাকবার জন্য। আর তিনি যে অগ্নিরূপে বৃদ্ধি পেতে লাগলেন সেই বৃদ্ধি ক্ষণস্থায়ী হোল না। অনন্তকাল ধরে তিনি বেড়ে চললেন। তিনি ঊর্ধ্বগতিযুক্ত হলে, তাঁর রশ্মিসকল ঊর্ধ্বগতিযুক্ত হলে, তার সেই বলকার্যকে ধারণ করার জন্য যে মহাশূন্য মহাকাশ সৃষ্টি হয়েছিল সেই মহাকাশে মহাশূন্য সেই ঊর্ধ্বগতিযুক্ত রশ্মিসকল শয়ন করলো। আর সেই মহাশূন্যে রশ্মিরা শয়ন করে নমিত হয়ে পড়লো আর শুভ্র জ্যোতি ধারণ করলো। এই যে জ্যোতির্ময় ব্রহ্ম এ অবিনাশী অক্ষয় সনাতন। আর এই জ্যোতির মধ্যেই সমস্ত ভুবন সমস্ত লোক আশ্রিত। এঁকে অতিক্রম করে যেতে পারে এমন কোন বস্তু এ ভুবনে নেই। এই যে জ্যোতির্ময় ব্রহ্মরূপে আত্মা এর জ্যোতি হিরণ্যময়। মহাশূন্যে মহাকাশে ইনি হিরন্ময় জ্যোতিরূপে স্বীয় মায়ারূপ প্রজ্ঞার দ্বারা ব্যাপ্ত হয়ে নিজের মধ্যেই আহার ঘুরে এলেন অন্ডাকৃতি ধারণ করে। অন্ডের মধ্যের জীব যেমন আহরণের মধ্যে থেকে প্রাণননক্রিয়া করে যেতে থাকে ইনিও তেমন হিরণ্ময় আবরণসুক্ত অন্ডাকৃতি ধারণ করে এই বিশাল ব্রহ্মান্ডের মধ্যে প্রাণনক্রিয়ায় ব্যাপ্ত রইলেন স্বীয় মায়ারূপ প্রজ্ঞার সঙ্গে অবিভাগাপন্ন হয়ে ঠিক সেইভাবে যখন তিনি সৃষ্টির প্রারম্ভে অবিদ্যমান মায়াবস্তুর সঙ্গে যুক্ত থেকে বায়ুশূন্য প্রাণনক্রিয়া করছিলেন। হিরন্ময় অন্ডের গর্ভভূত সেই অনন্ত বিশাল ব্রহ্মান্ডের পূর্বে শয়ন করে তিনি ‘পুরুষ’ নামে খ্যাত হলেন। সেই হিরণ্যগর্ভভূত অন্তরপুরুষ যিনি সর্বগত, যাঁর দ্বারা সর্বজগৎ ব্যাপ্ত, যিনি সকলের অন্তরে বিরাজ করেন, তিনিই পরমব্রহ্ম পরম-আত্মা। তিনি যখন সর্বজগৎ ব্রহ্মান্ডরূপে ব্যাপ্ত করলেন তখন তিনি বহু হবার কামনা করে প্রকৃষ্টরূপে জাত হলনে। তিনিই জাত হলেন ‘প্রজা’রূপে আর তিনিই তার পালয়িতা হলেন বলে তিনি ‘প্রজাপতি’ রূপেও খ্যাত হলেন। ছিলেন ‘দহর’ অতি ক্ষুদ্র, হলেন ব্যাপ্ত বহুরূপে; আর সকলের অন্তর পুরুষরূপে সকলপুরে সকলদেহে শায়িত হলেন, অধিষ্ঠিত হলেন, অধিষ্ঠিত হলেন বিন্দুবৎ অতি ক্ষুদ্ররূপে। তিনি যখন ব্যাপ্ত হলেন তখন সেই পুরুষ হলেন সহস্র মস্তক, সহস্র চক্ষু, সহস্র চরণ। কিন্তু তিনি সকল কিছু হয়ে ও সব কিছুকে অতিক্রম করে ক্রান্তদর্শীরূপে সকল কিছুর ঊর্ধ্বে অবস্থান করলেন। নিজের সৃষ্টির চেয়ে তিনি মহৎ হয়ে রইলেন। এই যা হয়েছে আর ভবিষ্যতে যা হবে সকলই সেই পুরুষ। এই বিশ্বজীব তার এক আওংশ মাত্র, যা ভূত ভবিষ্যৎ ও বর্তমান এই তিন কালের সংসারচক্রের মধ্যে অবস্থিত। সেই পুরুষের অপর যে তিন অংশ তা এই তিনকালের অতীতরূপে ঊর্ধ্বে সেই পরমস্থানে অবস্থান করলো যে পরমস্থানের বিষয় মানুষের চিন্তাজগতের অনধিগম্য। সেই পুরুষ যে এক অংশের দ্বারা চেতন ও অচেতন সকল পদার্থকে ব্যাপ্ত করলেন তা থেকে যজ্ঞের সুত্রপাত। যিনি এক অদ্বিতীয়রূপে ছিলেন তিনি বহুরূপে বিচিত্র লীলা করবার ইচ্ছা করলেন। তিনি যাচ্ঞা করলেন; তিনিই পূজা করলেন; তিনিই বহু হয়ে সকলের সঙ্গে মিলিত হলেন; তিনিই নিজেকে নিজে সকল কর্মে দান করলেন, অর্পণ করলেন। আর এ সকলই যজ্ঞকর্ম এবং তিনিই স্বয়ং যজ্ঞ। আর এই যজ্ঞ কর্মে তিনিই প্রথম বলি। তিনি তাবৎ বস্তুকে নিরীক্ষণ করলেন সমান দৃষ্টিতে; তাই তিনি পশু। আর তিনিই প্রথম যজ্ঞীয় পশুরূপে নিজ বহ্নিতে আহুতি দিলেন। সেই অগ্নিই নিজেকে নিজে অগ্নিতে আহিতি দিলেন, বিভিন্ন আকৃতিতে খন্ড খন্ড হলেন, আর সেই আহিতিভারকে স্বয়ং বহন করে চললেন অনন্তকাল ধরে মহাশূন্য মহাকালরূপে। এই কালই অশ্ব যা সকল কিছু বহন করে নিয়ে চলে। এই যজ্ঞীয় অশ্বের শীর্ষে রইলেন ঊষা – প্রথম আলোর চরণধ্বনি। তাঁর পশ্চাতে আগমন করলেন সূর্য চক্ষুরূপে, যিনি সর্বলোককান্ত, যিনি সর্বলোকের দ্রষ্টা। এই মহাভোজী অশ্বরূপী মহাকাল সপ্তরশ্মি, অবিনাশী, অজর, সহস্রচক্ষু, ভূরিরেতা, যা বহু প্রজননের অধিকারী এবং যার গর্ভে জন্মবীজ নিহিত। বহু প্রজননের জন্য এই কালকেই মানুষ পূজা করে। এই কালের চাকা এই বিশ্বভূবন। এই কালচক্রেই আরোহণ করে মানুষের মধ্যে যাঁরা উত্তমদ্রষ্টা সেই ঋষিগণ এই ব্রহ্মকে নিরীক্ষণ করলেন। আর সে পুরুষ যিনি এইভাবে সব হয়েছেন, তিনিও এই সব নিরীক্ষণ করলেন। তিনি এই সব সৃষ্ট জগতের মধ্যে প্রবেশ করতে চাইলেন। আর তার সৃষ্ট জগতে প্রবেশ করতে ইচ্ছা করে তিনি যখন বিশ্বকে নিরীক্ষণ করলেন তখন নিজেই বলে উঠলেন – ‘অহো, আমিই আমাকে আমার আত্মস্বরূপে এই স ‘ইদম্’ রূপে দেখলাম।’ সেই ‘ইদম্’-ই প্রত্যক্ষভাবে পরমাত্মা। তিনিই ‘ইদম্’ রূপে দ্রষ্টা হয়ে ‘ইদন্দ্র’ নামে খ্যাত হলেন। এই ‘ইদম্’-ই পরোক্ষভাবে ‘ইন্দ্র’ নামে অভিহিত।
কিন্তু এই যে দৃশ্যমান বস্তু যা বহুপ্রকারে বহুরূপে জাত, তা কোথা হতে সৃষ্টি হোল? কেই বা তা দেখেছে? কেই বা তা বলে দেবে? যে উপাদান কারণ থেকে এই সর্বজগতের উৎপত্তি তা তো পরে জন্মেছে। যারা পরে জন্মেছে তারা কেমন করে বলবে সৃষ্টির উপাদান কারণ কি? যিনি এই সমস্ত সৃষ্টির কারণ তিনি হয়তো একে ধারণ করে আছেন, হয়তো নেই। যিনি স্বীয় মহিমার সত্যস্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে এই জগতের অধ্যক্ষরূপে পরম ব্যোমে অবস্থান করছেন তিনিই হয়তো এইসব জানেন, হয়তো জানেন না। তবে কে দেখলো এই সব? কে-ই বলবে সে কথা?
এই প্রশ্ন চিরন্তন। এ প্রশ্ন ঋষির, আর এই প্রশ্নের উত্তর জানবার জন্য মানুষদের মধ্যে যাঁরা শ্রেষ্ট মানুষ তারা, করে কোন্ যুগে কত দীর্ঘ হাজার হাজার বছর আগে, তা কেউ জানে না, কোন কিছু অধ্যয়ন না করে তপস্যায় বসলেন, সৃষ্টিরহস্যের সন্ধানে। এই বেদ বা জ্ঞানলাভের জন্য স্বভাবনির্মল তপস্যানিরত মনুষ্যশ্রেষ্ঠদের সামনে স্ব্যয়ম্ভু স্বয়ং উপস্থিত হলেন। আর তখন তাঁরা ব্রহ্মকে সমগ্র বেদকে সমস্ত জ্ঞানকে স্বরূপে দর্শন করে ব্রহ্মজ্ঞানী হয়ে ব্রাহ্মণরূপে অভিহিত হলেন। যেখানে নয়ন গমন করে না, সেখানে বাক্য গমন করে না, সেখানে মনও গমন করে না, যে ব্রহ্মের স্বরূপ নিজেরই জানা নেই তা অপরের জ্ঞানের বিষয়ীভূত কিভাবে করা যাবে? তাই তপস্যারত পুরুষদের সামনে স্বেচ্ছায় শরীর পরিগ্রহ করে স্বয়ং বেদ যখন উপস্থিত হলেন তখন-ই তা জ্ঞানের গোচর হল। আর এইভাবেই বিনা অধ্যয়নে দর্শনক্রিয়ার দ্বারা সমগ্র বেদরাশি সেই তপস্যানিরত পুরুষদের সামনে স্বয়ং সমাগত হয়েছিলেন বলে সেই ব্রাহ্মণগণ ঋষি হয়েছিলেন। এই ঋষিগণ সেই ধর্মের (=যাঁর দ্বারা সকল কিছু ধৃত) সাক্ষাৎ দ্রষ্টা হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে যাঁরা ধর্মকে সাক্ষাৎ করেন নি অথচ সমগ্র বেদরহস্য জানতে ইচ্ছুক ছিলেন সেই পরবর্তীকালের ঋষিদের পূর্ববর্তী সাক্ষাৎধর্মা ঋষিগণ সমগ্র বেদরহস্য মন্ত্রের দ্বারা উপদেশের দ্বারা প্রদান করেছিলেন।
এই যিনি ইন্দ্রিয়জ্ঞানের অগোচর – অদৃশ্য, কর্ম-ইন্দ্রিয়ের দ্বারা যাঁকে গ্রহণ করা যায় না – অগ্রাহ্য, যাঁর মূল জানা নেই – অগোত্র, যিনি সকল বর্ণ ও রূপের কারণ হয়েও নিরাকার – অরূপ, যিনি সর্বদর্শনকারী হয়েও চক্ষুহীন – অচক্ষু, যিনি সর্বশ্রবণ সমর্থ হয়েও কর্ণহীন – অশোত্র, যিনি সর্বকর্মকারী এবং সর্বত্রগমনকারী হয়েও হস্তপদ-বিহীন – অপাণিপাদ, যিনি নিত্য, বিবিধপ্রকারে বর্তমান থেকে বিভু, যিনি সর্বগত, যিনি সূক্ষ্মাতি-সূক্ষ্ম, যিনি অব্যয় এবং সর্বভুতবর্গের কারণ, তাঁকেই বিবেকীরা ‘পরাবিদ্য’ রূপে সর্বত্র দর্শন করেন। ইনিই পরাবিদ্যা, ইনিই সর্বজ্ঞ, সর্ববিদ্, ইনি-ই সর্বজ্ঞানময় তপস্যা, ইনি-ই ব্রহ্ম, ইনি-ই রূপ, ইনি-ই অমৃতরূপে বারি, ইনি-ই অন্নরূপে জাত। এই পরাবিদ্যার দ্বারা সেই অক্ষর অনিনাশী ব্রহ্মকে জানা যায়। এই অক্ষর হতেই অন্ন, অন্ন হতে প্রাণ, প্রাণ হতে মন, মন হতে সত্য, সত্য হতে লোকসমূহ, লোকসমূহ হতে অমৃতত্ব জাত হয়ে জাগতিক ক্রম সম্পূর্ণ হয়। সেই প্রজ্বলিত তপস্যা থেকে ঋত জাত হোল, যজ্ঞ জাত হল, দিবা ও রাত্রি জাত হোল, জলপূর্ণ সমুদ্র জাত হোল, সংবৎসর জাত হোল; আর কালের নিয়মনিবদ্ধগতিকে পরিচালনার জন্য নক্ষত্রলোক, সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী ও অন্তরিক্ষ জাত হোল। এই জাগতিক সুনিয়ত কার্যক্রম ‘ঋত’ শব্দবাচ্য। এই ঋত-ই সত্য, যজ্ঞ, জল ও ধন নাম খ্যাত। আর যিনি ঋতকর্মের ধারক তিনিও ঋতদেবতা; ঋতম্ভর। তিনি অমৃতবারিরূপে; ‘ঋতং বৃহৎ’। তিনি হংসের মত শুদ্ধ অমৃতবারিকে আশ্রয় করে সর্বত্রগামী হয়ে দ্যুলোকে আদিত্যরূপে অধিষ্ঠিত। তিনি অন্তরিক্ষে বায়ুরূপে, তিনি পৃথিবীতে পার্থিব অগ্নিরূপে, তিনি অমৃতবারি সোমরূপে, তিনি সকল দেবতারূপে, আকাশরূপে সত্যরূপে, নদী, অন্ন, পর্বত – এই যা কিছু সব হয়েছে। কারণ তিনি যে মহান।
কিন্তু আ তো পরাবিদ্যা, তত্ত্বকথা। যিনি তপস্বী, যিনি তত্ত্বজ্ঞ, যিনি ঋষি তিনি এসব বুঝতে পারেন, দর্শন করতে পারেন এবং তত্ত্বকে জেনে তত্ত্বসন্বন্ধী যথার্থ জীবন যাপন করতে পারেন। কিন্তু যাঁরা কর্মব্যস্ত মানুষ যাঁদের নিত আহার সংগ্রহ করতে হয়, যা%রা সুখে শান্তিতে কালাতিপাত করতে চেন, যারা অন্নের উপায় জানতে চান, যাঁরা নিরোগদেহে নিরুপদ্রবে জীবনযাপন করতে চান, যাঁদের জন্য জীবনসংগ্রাম নিত্য সম্মুখ সমরের মত দুয়ারে দাঁড়ায়ে থাকে, যাঁরা অন্নময় প্রাণময় শরীর রক্ষায় সদা ব্যস্ত, তাঁদের জন্য এ তত্ত্ব কি মুল্য বহন করবে?
এ প্রশ্নের উত্তরও ঋষি দিয়েছেন। ঋষি বলেছেন – ব্রহ্মবিদ্ তো অন্নের নিন্দা করেন না। যাঁর অন্ন নেই তাঁর প্রজ্ঞাও নেই। যাঁর প্রজ্ঞা নেই তাঁর বলও নেই। যাঁর বল নেই তিনি এই আত্মাকে লাভ করতে পারেন না। আর আত্মাকে জানলেই পরাবিদ্যা লাভের পথ প্রশস্ত হয়। অন্নময় প্রাণময় মনোময় বিজ্ঞানময় আনন্দময় পুরুষই তত্ত্বগ্রহণে সমর্থ। আর যথার্থ তত্ত্বজ্ঞান সহায়ে জীবৎকালে মুক্ত অবস্থায় সকল কর্ম করেও অভয় ও সদানন্দ হন।
তবে কি ভাবে সংসারমার্গে বিচরণকারী মানুষ পরমজ্ঞান লাভ করতে পারে? এর উত্তরে বলা হয়েছে যে, মিথ্যাজ্ঞানজনিত যে বাসনা কামনা তা-ই ইহলোকের দুঃখের কারণ। এই মিথ্যাজ্ঞানজন্য যে বাসনা তা থেকে ক্রমমুক্তির উপায় জানতে হবে। আর তা জানবার জন্যই বেদের আলোচনা করতে হবে। পূর্বে বলা হয়েছে – দুটি বিদ্যাই জানবার আছে, একটি পরাবিদ্যা ও অপরটি অপরাবিদ্যা; সেই অপরাবিদ্যা পরাবিদ্যালাভের ইঙ্গিত দেয়। যে বিদ্যার ব্যবহারিক উপযোগিতা আছে, যা ইহলোকিক সুখের সন্ধান দেয় এবং পারলৌকিক মুক্তির উপায় তা অপরাবিদ্যা। সেই অপরাবিদ্যার মধ্যে ঋগ্বেদ, যজূর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দঃ ও জ্যোতিষ আলোচনার দ্বারা বিবেকী হওয়া সম্ভব। এই প্রযুক্তি বিদ্যাই দুঃখের পরপারে নিয়ে যেতে পারে; আত্মার সাক্ষাৎকার সহায়ক হতে পারে; দেবতার সঙ্গে সখ্যতা স্থাপনে সহায়ক হতে পারে। বালকেরা যেমন প্রথম বস্তুর নাম শেখে এবং পরে শিক্ষালাভের দ্বারা ক্রমে ক্রমে উৎকৃষ্ট জ্ঞান সঞ্চয় করে ও সেই জ্ঞানকে কর্মের সহায়রূপে নিযুক্ত করে, ঠিক সেইভাবে বেদচর্চার দ্বারা প্রতিটি মানুষ জ্ঞান অর্জন করে ইষ্টবস্তু লাভ করতে পারেন। সকল ব্যক্তিই যেমন চক্ষুকর্ণহস্তপদবিশিষ্ট হলেও সমান যোগ্যতাসম্পন্ন হন না তেমনি যার যেমন সাধনা যার যেমন যোগ্যতা সেই অনুসারে বেদচর্চা করলে ক্রমেই শ্রেয় লাভ করেন।
এখন দেখা যাক, যে ঋগ্বেদ, যজূর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ, শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দঃ ও জ্যোতিষ, যা অপরাবিদ্যা নামে অভিহিত হোল, তার আলোচ্য বিষয় কি? পূর্বে বলা হয়েছে, যিনি জগতের কারণ তিনি প্রথমে সূক্ষ্মাতি-সূক্ষ্ম রূপে স্বীয় মায়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি পরে তাঁর ইচ্ছামাত্র সেই ঐশী মায়াশক্তির সঙ্গে যুক্ত থেকে এই সব কিছু হলেন। তাঁর সেই অদীনা অক্ষীণা ঐশী মায়াশক্তি অদিতিই সকল কিছুর জন্ম দিয়েছেন বলে এই যা কিছু দৃশ্য পদার্থ তা আদিত্য নামে অভিহিত। তার মধ্যে আমাদের জীবকূলের প্রয়োজনে সূর্যরূপে যিনি জাত হলেন, তিনি জগতের চক্ষু, তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ বলে ‘আদিত্য’ নামে পরিচিত হলেন। এই সূর্যমন্ডলের অধীনে তিনলোক। সূর্য যেখানে যে পরমস্থানে (আধুনিক বিচারে নয় কোটি তিরিশ লক্ষ মাইল দূরে) বাস করেন, সেই স্থান দ্যুলোক। এই পৃথিবী যেখানে আমাদের বাসনা-কামনা সুখ-সম্পদ দুঃখ-ব্যাধি ভয়-নিরাপত্তা প্রভৃতি বর্তমান তা ভূলোক। দ্যুলোক ও ভূলোকের মধ্যবর্তী যে আকাশ তা তা অন্তরিক্ষলোক, স্বপ্নময়লোক। এই দ্যুলোক, ভূলোক ও অন্তরিক্ষলোক এবং এরই মধ্যবর্ত্তী আর যা কিছু সব সুর্যমন্ডলের অন্তর্গত। যিনি অগ্নিরূপে যাত্রা করেছিলেন সৃষ্টির প্রারম্ভে তিনিই দ্যুলোকে সূর্যরূপী অগ্নি, অন্তরিদখে বিদ্যুৎরূপী অগ্নি এবং পৃথিবীলোকে পার্থিব অগ্নিরূপে অধিষ্ঠিত হলেন। আর সূর্যমন্ডলের বাইরে সেই প্রম অগ্নি অসংখ্য নক্ষত্ররূপী জাত হলেন।
এই যে সূর্য ইনি প্রত্যক্ষ দেবতা। ইনিই আত্মা। আত্মার সাক্ষাৎকারের জন্য অনেকে অনেক উপায়ের সন্ধান দেন কিন্তু যিনি সূর্যতে আত্মার অধিষ্ঠানের বিষয় জানেন তিনি সহজেই আত্মার সাক্ষাৎকার করেন। প্রকৃতপক্ষে আত্মা আমাদের থেকে কখনও দূরে নেই। তিনি মানুষের মধ্যে অহং বা ‘আমি’ রূপে পরিচিত। আর তিনিই আত্মজন্মা ও স্বেচ্ছাজন্ম হয়ে স্বকার্যসাধনের জন্য প্রত্যক্ষভাবে সূর্যে অধিষ্ঠিত আছেন। যা দীপ্তি দেয় তাই ‘দেব’। ঐশ্বর্যদান করেন বলে তিনি ‘দেব’। তেজঃস্বরূপ বলে সকল পদার্থকে প্রকাশ করেন, তাই তিনি ‘দেব'; আর দ্যুলোকে অবস্থিত বলে তিনি ‘দেব’। যিনি দেব তিনিই দেবতা। আর সেই পরম অগ্নি যিনি সকল অগ্নিরূপে বিশ্বের সকল ভবনে সকলস্থানে অগ্নি নামেই খ্যাত হয়ে আছেন সেই অগ্নিই সকল দেবতা। এই পৃথিবীতে যিনি অগ্নিরূপে পরিচিত তিনিও সেই অগ্নি। বিশেষ কর্মে বিশেষ অধিকারের জন্য সেই আত্মারূপী একই অগ্নি বিভিন্ন নামে পরিচিত। তিনি ইন্দ্র-মিত্র বরুণ সুপর্ণ গরুতান্ মাতরিশ্বা যম অজ একপাৎ, ত্বষ্টা, বিশ্বানর, বৃষাকপি, আদিত্য, বিষ্ণু, পূষা, ভগ, রুদ্র, সবিতা কেশী প্রভৃতি নানা নামে বহুরূপে বর্ণিত হন। আর এই যে আদিত্য সূর্য এঁর রশ্মিসকলও দেবতা। এই কিরণরাশিই ‘দেবগণ’ বা ‘বিশ্বদেবগণ’ নামে পরিচিত। এই ‘বিশ্বদেবগণ’ কোন বিশেষ শ্রেণীর দেবগণ নন, এঁরা সকল দেবতার বোধক। তবে একথা সকলে স্বীকার করেন না। বিরুক্তকার শাকপূণি বলেন, বিশ্বদেবগণ বিশেষ ধরণের একশ্রেণীর দেবতা, যাঁরা বিশেষ কার্য সম্পন্ন করেন। এঁরা সংখ্যায় তেত্রিশ – দ্যুলোকে এগার, পৃথিবীতে এগার, এবং অন্তরিক্ষেও এগার। ব্রাহ্মণগ্রন্থে বলা হয়েছে, অষ্টবসু, দ্বাদশ আদিত্য, একাদশ রুদ্র, প্রজাপতি ও বষট্ কার – এই তেত্রিশ বিশ্বদেবগণ। এই বিশ্বদেবগণ নিজ মহিমায় সমস্ত যজ্ঞকর্মকে মিলিত করেন। মনে রাখতে হবে সকল সুকর্মই যা সকলের সঙ্গে মিলিত হয়, পূজিত হয়, পার্থিত হয় তা যজ্ঞকর্ম। সূর্য মন্ডলের অধীনে গণদেবতাদের মধ্যে বসুগণ, রুদ্রগণ, আদিত্যগণ, মরুৎগণ, সপ্তঋষিগণ, সাধ্যদেবগণ, বাজিগণ, বিশ্বদেবগণ, ঋভুগণ, আঙ্গিরোগণ, পিতৃগণ, অথর্বগণ, ভৃণ্ডগণ, আপ্তাগণ, দেবপত্নীগণ প্রধান। এই গণদেবতারা কর্মবিভাগ অনুসারে পৃথক পৃথক। বলা বাহুল্য, এঁরা সকলেই সূর্যের রশ্মির বিভিন্ন কার্যসাধনরূপ; যেমন মরুৎগণ প্রাণবায়ু, আদিত্যগণ সূর্যের দ্বাদশমাসের দ্বাদশরূপ, রুদ্রগণ রোগ উৎপন্ন করে বিনাশসাধন করেন, সাধ্যগণ বৃষ্টিদানরূপ অসাধ্য সাধন করেন, দেবপত্নীগণ জলের পালিকা শক্তি, বাজিগণ যজ্ঞকর্মকে ব্যাপ্ত করেন, ভৃণ্ডগণ বাষ্পীভূত বারিরাশিকে শুষ্ক করেন, বসুগণ সর্বলোকে ব্যাপ্ত ধনদানকারী রশ্মি, পিতৃগণ সূর্যের দক্ষিণায়ন-কালীন বর্ষণকারী রশ্মি, অথর্বগণ অগতিস্বভাব স্থিররশ্মি ইত্যাদি। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, বিরুক্তকারগণ বলেন, সকল রশ্মিই সমান দীর্ঘ নয় বা বিস্তৃত নয় এবং সকলের কর্মসম্পাদ ক্ষমতাও সমান নয়, রশ্মিগনের মধ্যে পাঁচটি অশ্বরশ্মিই দীর্ঘাকার। বৃষ্টিপ্রধান, জলরস আহরণ প্রভৃতি কর্মে নিযুক্ত রশ্মিগণকে যে শক্তি পালন করে থাকেন তাঁরা দেবপত্নী নামে বা দেবী নামে অভিহিতা। এই দেবী শক্তি সেই ঐশী অদীনা অক্ষয়া মায়াশক্তি প্রজ্ঞা যিনি আত্মার সঙ্গে অবিভাগাপন্না, তাঁরই বিস্তার। এঁদের মধ্যে সরস্বতী, সূর্যা অগ্নায়ী, ইন্দ্রাণী, অশ্বিনীরাট্, রোদসী, বরুণানী প্রধানা। প্রতি ঋতুতে কালে কালে যে যজ্ঞকর্ম সাধিত হয় তাই ঋতুপথ সত্যপথ। এই ঋতকর্মের প্রজ্ঞাকর্মের পালিকা শক্তি দেবপত্নীগণ। আর অগ্নিই সেই ঋতুপথে সত্য পথে সকল্কে নিয়ে চলেন। সকল যজ্ঞকর্মই অগ্নি করেন, মানুষেরা সেই যজ্ঞের অনুকরণ করেন মিত্র। যজ্ঞের সামান্য অংশই যাজ্ঞিক মানুশ সমাধান করতে পারেন। তবে যিনি অগ্নির ঋতকর্মের সত্যকর্মের সঙ্গে ভাবনার দ্বারা মননের দ্বারা একাত্ম হয়ে যান তাঁকে অগ্নি সঠিক পথে নিয়ে যান। তখন অগ্নির সঙ্গে সাধকের সখ্যতা হয়। এই যে অগ্নির স্বরূপ রশ্মিগণ যাঁরা নিত্য আমাদের ঘিরে আছেন, তারা শ্রবণসমর্থ, কর্মসমর্থ, প্রজ্ঞাযুক্ত নিরাকার চৈতন্য। এঁরাই অগ্নির দূতস্বরূপ, এঁরাই জানতে পারেন আমাদের মনোবাসনা কামনা। যা সত্য, যা ঋত, যা উন্নত, তা সকলই এঁদের অধীন। রশ্মির সঙ্গে সখ্যতাই দেবগণের সঙ্গে সখ্যতা তথা আত্মার সঙ্গে সখ্যতা। এই সখ্যতার দ্বারাই সর্বসিদ্ধি লাভ হয় আর এই দেবরশ্মিগণই আমাদের কুকর্ম থেকে নিবৃত্ত করে সত্যপথে নিয়ে চলেন। এঁরা এই কর্মে অতন্দ্র, অনলস। যদিও আমরা ভুল করি তথাপি এঁরা আমাদের সঠিক পথে নিয়ে যাবার জন্যই অপেক্ষা করেন। যখন কুকর্ম আর পাপ আমাদের মধ্যে প্রবল হয় ওঠে তখন এঁরা সেই পাপকে ধ্বংস করতে গিয়ে হয়তো আমাদেরও ধ্বংস করেন কিন্তু তার সকল কিছুতে জ্যোতিতে পরিণত করেন, কারণ জ্যোতিই সত্য ও পরম। এই ধ্বংসকর্ম যখন তাঁরা করেন, তখন পাপরূপ শত্রুকে দুঃখসন্তপ্ত করেন তখন তাঁরা রুদ্ররূপেই এই কর্ম করেন এবং কর্ম করার সময় নিজেরাও রোদন করেন; কারণ অগ্নির সকল কর্মই যে অহিংসিত কর্ম, তাঁর সকল যজ্ঞই অহিংসা। তিনি ভয়ঙ্কর হলেও করুণাসিন্ধু।  এই তাঁর প্রকৃত রূপ।
এই যে পরমাত্মা অগ্নি যিনি এক হয়েও প্রভূত ঐশ্বর্যবলে বহুনামে বহুরূপে স্তুত সেই পরমাত্মারই অঙ্গস্বরূপ অন্য দেবগণ। দেবতারা পরস্পর ভিন্ন এবং তাঁদের স্তুতিও পৃথক কারণ তাঁদের নাম ভিন্ন, কার্যও ভিন্ন। একই ব্যক্তি যেমন কখনও পিতা কখনও স্বামী কখনও বন্ধু, দেবতাদের কার্যও সেরূপ। দেবতাদের সংখ্যা বহু হলেও তাঁরা পৃথিবী, অন্তরিক্ষ ও দ্যুলোক – এই তিন স্থান ব্যাপ্ত করে বর্তমান আছেন। প্রকৃতপক্ষে অগ্নিই পরমাত্মা, বহুরূপে শ্রুত এবং সর্বদেবতা, যিনি ত্রিলোকব্যাপী। এই পৃথিবীর মানুষ, পশু, পক্ষী এবং আর সকল জীব ও অজীব যেমন পৃথিবীতে বাসকারী বলে ‘পার্থিব’ নামে পরিগণিত হতে পারে তেমনি দেবগণও তিনলোকের সম্যক্ পালনের দ্বারা ‘এক’ বলে পরিগণিত হতে পারেন। লৌকিক দৃষ্টান্তে এই ভেদাভেদ নর এবং রাষ্ট্রের মত।
সুতরাং কার্যসাধনের জন্য সেই এক পরম অগ্নি সূর্যরূপে জাত হলেন আর সূর্য হলেন তাঁর স্বীয় মণ্ডলের সম্রাট। তাঁর সাম্রাজ্যকে তিন প্রধান ভাগে ভাগ করে পরমাত্মা অগ্নির উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য তিনি নিরন্তর বাধ্যতামূলক কর্মে নিজে প্রবৃত্ত থেকে স্বীয় সাম্রাজ্যের সকলকেও সেই কর্মে নিযুক্ত করলেন। দ্যুলোকে তিনি রইলেন সূর্যরূপে; আকাশ ছাড়া কোন বলকার্য সম্ভব নয়। তাই কাকাশকে সকল বলকার্য সাধনের জন্য নিযুক্ত রেখে সেই আকাশে বজ্র বিদ্যুৎ বায়ু প্রভৃতিকে ইন্দ্র নামে পরিচিত করলেন। এই যা কিছু বলকার্য অন্তরিক্ষে, এবং এই পৃথিবীতে দেখা যায় তা সর্বই ইন্দ্রকর্ম। এমন কি অতি ক্ষুদ্র প্রাণীর কর্ম ও বলকর্ম বা ইন্দ্রকর্ম। আর সেই পরম অগ্নি এই পৃথিবীতে অগ্নিরূপে নিজেকে নিযুক্ত করলেন সর্বকর্মারূপে, বিশ্বের সকল অগ্নির সঙ্গে সন্বন্ধ রাখার জন্য। ঐ দূরে বহুদূরে দূরতম প্রদেশে, চিন্তার অনধিগম্য প্রদেশে যিনি অগ্নিরূপে বর্তমান, তিনিই এই পৃথিবীতেও অগ্নিরূপে বর্তমান। তিনি সেখানেও যা, এখানেও তা। সেই অগ্নিই এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার জন্য সূর্যের মধ্যে অবস্থান করলেন আত্মারূপে। জগতের আত্মা সূর্য তখন তাঁর রশ্মিদের সপ্তচ্ছন্দে ছন্দায়িত করে সপ্ত বায়ুস্তর ভেদ করে মানুষকে বিস্তীর্ণ সুজন্মা ভূমি প্রদানের ইচ্ছা করে পৃথিবী পরিক্রম করলেন। আমাদের উদার আশ্রয় দেবেন বলে রশ্মিগণকে নম্রভাবাপন্ন করে পৃথিবীতে প্রেরণ করলেন; তা না হলে তার রশ্মির প্রখর তাপে পৃথিবী যে ঊষর ভূমিতে পরিণত হবে। তাই তিনি সৃষ্টির কারণে, আনন্দের কারণে পৃথিবীতে সূর্যরশ্মির দ্বারা বিনীতভাবে প্রবেশ করলেন। যাঁর পদ অন্তরিক্ষ পরমস্থানে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত, যিনি ছলরহিত, যিনি কাউকে হিংসা করেন না, যিনি চরাচর বিশ্বের রক্ষক সেই বিষ্ণু সূর্য তিনপাদের দ্বারা অর্থাৎ উত্তরায়ণ, দক্ষিণায়ন ও বিষুববিন্দু স্পর্শের দ্বারা বিশ্বভূবন পরিক্রমা করেন। আর এই ভাবে জগৎ পরিক্রমা করে তিনি সকল ধর্ম, সকল ব্রত, সকল কর্মকেই ধারণ করে থাকেন। আদিত্যের কর্ম দ্বাদশ প্রকার। তিনি উদয় ও অস্ত গমনের দ্বারা দিন ও রাত সৃষ্টি করে বার মাস, ছয় ঋতু ও সংবৎসর রচনা করেন। আদিত্যের কর্ম রশ্মিসহায়ে জলরস আকর্ষণ, রশ্মির দ্বারা রসধারন, আর যা কিছু প্রচ্ছাদন প্রকাশন তা সমস্তই আদিত্যের কর্ম।  আদিত্যের উদয়ে ভারত্রি ও গ্রহ নক্ষত্রের প্রচ্ছাদন বা অন্তর্ধান হয়; অবিদ্যা দূর করে আদিত্য জ্ঞানের প্রকাশ সাধন করেন। এই যে আদিত্য ইনি কখনও অস্তমিত হন না, উদিতও হন না। ইনি সর্বদা একরূপ। তাঁকে যখন অস্তমিত মনে করা হয় তখন তিনি সেই দেশে দিনের সমাপ্তি করে রাত্রি করেন ও অন্য দেশে দিন করেন। আবার সখন তাঁকে প্রাতঃকালে উদিত মনে করা হয় তখন তিনি সেই দেশে দিন করেন ও অন্য দেশে রাত্রি করেন। এই ঊষা ও রাত্রি যেন দুই ভগিনী। সন্ধ্যার আগমনে অরুণ যখন ধূসরবর্ণ প্রাপ্ত হন তখনই রাত্রির আরম্ভ। এই ধূসরবর্ণা রাত্রি শ্যাবী নাম ধারণ করেন। ক্রমে রাত্রির রূপ পরিবর্তিত হতে থাকে। প্রথম রাত্রিকাল পর্যন্ত তিনি দোষারূপিণী, মধ্যরাত্রিতে তমস্বতী; আর নক্তারূপে রাত্রি অব্যক্তবর্ণা। তখন তিনি ব্যক্তবর্ণ দিনের বিপরীতরূপ এবং হিমবিন্দুর দ্বারা জগৎ সিক্ত করেন। তিনি ঊধঃরূপে স্নেহরস প্রদান করেন, বস্বীরূপে ভগিনী ঊষার আগমনের পথ করে দেন। জ্যোতিঃসমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এই ঊষা তখন বিচিত্র প্রকাশভঙ্গীতে অতি বিস্তারের সঙ্গে জন্মলাভ করেন। এই নক্ষত্রখচিত রাত্রিদেবী যেন ময়ূরপুচ্ছধারিণী, নিদ্রারূপ মায়াজাল বিস্তারে পাশহস্তা। রাত্রির আগমনে জনপদসমূহ নিস্তব্ধ, বিহঙ্গরা নীড়াশ্রয়ে সুখে বাস করে, পথচারী ও শ্যেন সকলেই শয়ন করে। রাত্রির অন্ধকার যেন ঋণের মত সর্বদা আচ্ছন্ন করে রাখে। ঊষার আগমনে ঋণের মত কৃষ্ণা রাত্রি দূরে চলে যান। রাত্রির শেষরূপ ‘বস্বী’ যখন ধনভারে অবনতা হয়ে ঊষার আগমনের পথ করে দিয়ে অন্তর্হিতা হন তখন ধনবতী ঊষা বিচিত্র ভঙ্গীতে তাঁর জ্যোতিকে অতি বিস্তীর্ণ করেন। ঊষা দেবী ভগিনী রাত্রিকে জ্যোতির দ্বারা অপাবৃত করে তমস্যার পারে দাঁড়িয়ে নিজে নিজেই হাসতে থাকেন। নিয়ত রূপ-পরিবর্তনকারিণী ঊষা ও রাত্রি কখনও স্থির হয়ে অবস্থান করেন না। সকল বস্তুর উৎপাদনকারিণী রাত্রি ও ঊষা ভিন্নরূপা হলেও সমানমনা; একে অপরকে বাধা দেন না। একে অন্যের বর্ণ বিনাশ করেন না, একে অন্যের পরে আগমণ করেন। পার্থিব ধনের ঈশ্বরী ঊষা কাউকে ধনের জন্য, কাউকে অন্নের জন্য, কাউকে যজ্ঞের জন্য, কাউকে বা অভীষ্টলাভের জন্য জাগরিত করেন। ভুবনপ্রকাশিকা ঊষা সকলের জীবনের উপায়। এই অহোরাত্রই জ্যোতি দ্বারা দিনকে এবং হিমের দ্বারা রাত্রিকে পরিব্যাপ্ত করেন। এই অহোরাত্রই দেশ ও কালে পরিব্যাপ্ত। এই কাল গতিযুক্ত, নমনীয়, দর্শনীয়, ধ্বংসকারী ও শব্দকারী। কাল-ই শস্য উৎপন্ন করে ও ভোজন করে; কাল-ই অতি প্রসারিত ক্ষিপ্রহস্তযুক্ত; কাল-ই কল্যাণকারী, বহুভোজী। এই বুদ্ধি নিহিত; কাল-ই বহুকর্মকারী, অপ্রতিহতগতি, শত্রুক্ষয়কারী, রোগনাশকারী, মিথ্যারহিত, শত্রুরোদনকারক, আবার কালই স্বয়ং রোদনকারী। এই কালের গতিচক্র সদা সচল থাকে বৃষ্টি সম্পাদনের দ্বারা, অমৃতবারি বর্ষণের দ্বারা, যা একধনা, যা পেলে মানুষ বাঁচে, শস্য উৎপন্ন হয়, সংসার চক্র নিজ নিয়মে চলতে থাকে। এই বৃষ্টিসম্পাদন, মেঘবিদারণ ও যা কিছু বলকার্য তা সমস্তই ইন্দ্রকর্ম। এমন কি কীটপতঙ্গাদির দ্বারা যে বলকর্ম সাধিত হয় তা সমস্তই ইন্দ্রকর্ম, কারণ বলই প্রাণ, প্রাণই বায়ু, বায়ুই ইন্দ্র। আদিত্য যে রসধারা আকর্ষণ করেন, সেই অমৃতবারিকে ইন্দ্র লোকপালনের জন্য বৃষ্টিধারারূপে বর্ষণ করেন। এই আদিত্য বিষ্ণু সত্যধর্ম ধারণ করতে করতে কর্মসমূহ সৃষ্টি করেন, যে কর্মসমূহের দ্বারা সঙ্কল্প ইচ্ছাশক্তি আজ্ঞা শাসন মর্যাদা নিয়ম বশ্যতা সেবাবৃত্ত ও অধিকার ঐশ্বর্য ও আধিপত্যরূপ ব্রতধর্ম কর্ম সকল রচিত হয়। তাঁর এই ব্রতকর্ম হতে মানুষেরা জীবনধারণপ্রণালী, আচার, ব্যবহার, ধর্মীয় শাসনের প্রতি প্রষস্ত অনুরাগ, তপস্যাজনিত কৃচ্ছ্রতা, পবিত্র ব্রতবদ্ধ জীবনের অভ্যাস করে তাঁর কাছ থেকে মানুষ অনলস অতন্দ্র কর্ম শেখে যে কর্ম জীবের সকল কামনা পূরণ করে। যে আদিত্যরূপী বিষ্ণু দ্যুলোকে দূরতম প্রদেশে অতি উত্তম স্থানে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থেকে সকল কর্ম ধারণ করে জগৎ পালন করেন, তাঁকে ঘিরেই রয়েছে বিশ্বের সকল জ্ঞান। এই জ্ঞান গুণগত বিচারে ঋক্, সাম, যজু, ও অথর্ববেদ এই চার ভাগে বিভক্ত। এই জ্ঞানসমূহ আদিত্যদেবের কিরণরাশিকে আশ্রয় করে রেয়েছে; এরা যেন কিরণরাশির মধুনাড়ীসমূহের মধুকরবৃন্দ। এই কিরণরাশি নিখিল জ্ঞনকে আশ্রয় করে লোহিত, শূভ্র, কৃষ্ণ ও অতিকৃষ্ণচ্ছটা ধারণ করে যথাক্রমে ঋক্, যজু, সাম ও অথর্ববেদ নামে অভিহিত হয়। পূর্বে যে তিন লোকের কথা বলা হয়েছে সেই তিন লোক – অ, উ, ম, এই তিন অক্ষরাত্মক নামেও পরিচিত। অ = পৃথিবী। উ = অন্তরিক্ষ। ম = দ্যুলোক। অ + উ + ম = ওম্। ওম্ শব্দের দ্বারা পূর্ণ ব্রহ্মকেই বোঝান হয়েছে; এই তিন লোকের অতিরিক্ত যে জগৎ যা মানুষের বাক্য ও মনের অগোচর তাও ওঙ্কার; এবং যেহেতু সূর্যের মধ্যে পরমাত্মার প্রকাশ সেহেতু ওম্ শব্দে ত্রিলোকব্যাপী জগতের আত্মা সূর্যের অধিষ্ঠানকেও বোঝায়। এই আদিত্য সূর্য নীলাতিগ কৃষ্ণচ্ছটা থেকে দীপ্তিলাভ করে ‘ওম্’ উচ্চারণের দ্বারা আকাশ পথে বিচরণ করেন। আর তিনি এইভাবে ঋতের ছন্দে বলতে বলতে উদক, ধন ও সত্য সৃষ্টি করেন; আর সকল কর্মকে স্পর্শ করে আতিক্রান্ত হন। তাঁর এই সকল কর্মঈ ঋত এবং তিনিই ঋতদেব। এই প্রত্যক্ষ দেবতা সূর্য নর বা পুরুষাকৃতি নন বলে অপুরুষব্ধি। ইনি হস্তপদবিহীন, ইনি চলেন, অথচ চলেন না; আর এঁকে ঘিরেই নিখিল বেদ বা জ্ঞান বর্তমান। ইনি নিত্য, কতকাল ধরে উদিত হচ্ছেন, কতকাল ধরে উদিত হবেন তা কেউ জানে না। নিত্য বলেই ইনি যুগে যুগে কবি জ্ঞানী ঋষিদের আলোচনার বিষয়। সূর্য বলে বেদও নিত্য ও অপৌরুষেয় কারণ অপুরুষবিধ সূর্যকেই আশ্রয় করে রয়েছে ঋক্, যজু, সাম ও অথর্ববেদের সকল জ্ঞান। বেদে যত কিছু ভাবনা রয়েছে তা সকলেই বীজাকারে। বেদতত্ত্ব বোঝবার জন্য ষড়বেদাঙ্গ – শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দঃ ও জ্যোতিষ। তার বেদতত্ত্বকে বিস্তৃত আকারে কাব্যরয়াশ্রিত সাহিত্যের মাধ্যমে যুগে যুগে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য লেখা হয়েছে পুরাণগুলি। সূর্য নিত্যবলে যেমন সকল কালেই সূর্যসংক্রান্ত আলোচনা হয়ে থাকে এবং আজও হয়, তেমনি বেদ সূর্য আশ্রিত বলে সকল কালেই বেদের তত্ত্ব নিরুপণ হয়ে থাকে তেবং আজও হয়।
এই আদিত্য সূর্যের পরমপদে যে মধুর উৎস সেই মধুই ধর্ম। এই ধর্ম বায়ুতে, নদীতে, ওষধিতে, দিবারাত্রিতে, পৃথিবীর ধূলায়, দ্যুলোকে, বনস্পতিতে, কিরণরাশিতে সর্বত্র মধুর মধুররূপে প্রবাহিত হয়ে সকল কিছুই মধুময় করে তোলে। এই ধর্ম সর্বভূতের মধু, সর্বভূত এই ধর্মের মধু। যিনি এই ধর্মে তেজোময় অমৃতময় পুরুষ তিনিই এই আত্মা এই অমৃত এই ব্রহ্ম এই সব। বিজ্ঞান যাঁর সারথি, মন যার সুনিয়ন্ত্রিত, তিনি যে পথের পারের সন্ধান পান তাই আদিত্য বিষ্ণুর পরম পদ। সমস্ত জীবের প্রতি দয়া ক্ষমা শান্তি অহিংসা সত্য ঋজুতা অদ্রোহ অনভিমান লজ্জা তিতিক্ষা ও শম – এই সকলই পরম ব্রহ্মকে লাভের পন্থা। আর সূর্যরূপী জগতের আত্মার প্রতি মনোনিবেশ করে বিদ্বান ব্যক্তি কর্মকে নিশ্চিতরূপে জেনে সেই পরম তত্ত্বকে সম্যক্ দীপ্তি করেন।
পুর্বে যে কথা বলা হয়েছে, ত্রিমাত্রাত্মক ‘ওম্’ এই অক্ষররূপ প্রতীকের দ্বারা সুর্যমন্ডস্থ পরম্পরুষকে বোঝাচ্ছে, সেই ওঙ্কার অবলম্বনেই বেদবিদ্যাবিহিত কর্ম করে হয়, ওম্ উচ্চারণ করে দেবতাদের শ্রবণ করে হয়, ওম্ উচ্চারণ করে স্তোত্রপাঠ ও সাম গান করা হয়। ওম্ এই অক্ষরের পূজার জন্য সাধকের জীবনের সঙ্গে মনমের দ্বারা এই অক্ষর ব্রহ্মকে মিলিত করার জন্য ওম্ এই অক্ষরের নিজ মহিমার দ্বারা এবং এই ওম্ অক্ষরের পরিণামভূত অন্ন-জল প্রভৃতির রস হতে নিষ্পন্ন হবির দ্বারা এই ওম্ অক্ষরের উদ্দেশ্যই পূজা করা হয়। যিনি অঙ্কারূপ অক্ষরকে এইভাবে জানেন এবং যিনি তা’ জানেন না, তাঁরা উভয়েই এই অক্ষরব্রহ্মে অবস্থিত থেকে সকল কর্ম করে থাকেন বটে, কিন্তু যিনি ওঙ্কাররূপে অক্ষর বিজ্ঞান জানেন ও শ্রদ্ধাসহকারে উপাসনাতি করেন তিনি অধিক ফললাভ করেন। যিনি অক্ষর ব্রহ্মকে লাভ করতে চান তিনি ‘ওম্’ উচ্চারণের দ্বারাই লাভ করেন। কারণ ওঙ্কারই ধনু, জীবাত্মা শর, এবং ব্রহ্ম সেই শরের লক্ষ্য। সাধক প্রমাদহীন হয়ে লক্ষ্য ভেদ করে লক্ষ্যের সঙ্গে অভিন্ন হন। অজ্ঞানরূপ অন্ধকারের অতীত পরপারে যাবার জন্য ওঙ্কার-ই অবলম্বন।
যা শব্দ করে তা স্বর; আর সূর্য ‘ওম্’ শব্দ করে ভ্রমণ করেন বলে সূর্য-ই ‘স্বর’। সুতরাং এই ‘ওম্’ অক্ষরও ‘স্বর’, এবং এই ওঙ্কার-ই অমর ও অভয়। এই ওঙ্কার প্রবেশ করে দেবরশ্মিগণও অমর হন।
পূর্বে যে বলা হয়েছে, ওম্ উচ্চারণ করে সামগান করে হয়, সেই সামগান সূর্যকে ঘিরে হয়। সা = প্রকৃতি বা অদীনা অক্ষয়া ঐশীশক্তি; অম্ = আত্মা, যা সূর্য-মণ্ডলের মধ্যে আসীন। সুতরাং সূর্যরূপ জগতের আত্মার সঙ্গে যা ওতপ্রোত তা ‘সাম’। আর যেহেতু ঋক্মন্ত্রের দ্বারা সামগান করা হয় সেহেতু ঋক্-ই সাম, এবং সাম-ই সূর্য। আর, যেহেতু সূর্যই সাম ও অঙ্কার, এবং সূর্যই প্রাণরূপে প্রতিষ্ঠিত সুতরাং প্রাণও ‘ওম্’ উচ্চারণ করে এই জীবদেহেই বিভরণ করে। আর যেহেতু পৃথিবী, দ্যুলোক ও অন্তরিক্ষলোক পরস্পর সন্বন্ধযুক্ত ও একাত্ম, সুতরাং অঙ্কাররূপ সামসঙ্গীত যা সূর্যইসঙ্গীত তা সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত। চরাচর ভূতবর্গ ঊর্ধ্বে অবস্থিত আদিত্য সূর্যেরই স্তব করে থাকেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সামের আশ্রয় ‘স্বর'; স্বরের আশ্রয় ‘প্রাণ'; প্রাণের আশ্রয় ‘অন্ন'; অন্নের আশ্রয় ‘জল'; জলের আশ্রয় পুনরায় ‘স্বর’ বা আদিত্য সূর্য, যাঁকে ঘিরে জল সদা বর্তমান। সুতরাং স্বর বা স্বরলোকের অথবা স্বর্গলোকের অতীত আশ্রয়ান্তের আমাদের কেউ নিয়ে যেতে পারে না। যে সূর্যকে ঘিরে জল সদা বর্তমান সেই জলরাশি অন্তরিক্ষে বিচরণ করে, মেঘগর্জন করে জল দান করে, যা হতে সর্বভূত জাত হয়। অন্তরিক্ষে অবস্থিত এই মেঘগর্জনই বাক্ বা বাক্যরূপে অধিষ্ঠিত, যা বৃষ্টি জল সৃষ্টি করে শব্দ করে। এক বাক্ হতে মেঘ বারিবর্ষণ করে, বাক্ হতে চতুর্দিকে আশ্রিত সর্ববস্তু জাত হয়, বাক্ বা শব্দ হতে অক্ষর সৃষ্টি হয়, এবং এই বাক্-ই বিশ্বের উপজীব্য। এই বাক্ই বিশ্বরূপ সকল উয়ব উচ্চারণ করে; এবং বেদবাক্য ও অন্যান্য লৌকিক বাক্য সকলই এই অন্তরিকশে অবস্থিত মেঘগর্জনরূপ শব্দেরই বাক্ রূপে বিস্তার। তাহলে আকাশরূপ ব্রহ্মই বাক্যের পরমস্থান। আর সমস্ত দেবরশ্মিগণই আকাশব্রহ্মে অবস্থিত বাক্যের বা শব্দের মধ্যে প্রবেশ করে আছেন। এই বাক্-ই অক্ষর বা অবিনাশী, আর তিরলোকাত্মক ‘ওম্’ এই অক্ষরও অবিনাশী। অতএব ‘ওম্’ এই অক্ষরই – এই সমস্ত। ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান – এই সকলি ওঙ্কার, এবং অপর যা কিছু ত্রিকালের অতীত তাহাও ওঙ্কার। এই সমস্তই ব্রহ্ম। যিনি সাধক তিনি যদি এই সমস্ত জেনে তিনলোকের ভাবনাকে একত্রে সম্মিলিত করেন তবে ওঙ্কাররূপে প্রতীক অবলম্বনের দ্বারা যা শান্ত, অজর, অমৃত, অভয় ও সর্বোত্তম তা প্রাপ্ত হন। সর্প যেমন জীর্ণ ত্বক-মুক্ত হয়, সাধকও তেমনি ত্রিমাত্রাত্মক ওঙ্কাররূপ সামের দ্বারা ঊর্ধ্বে হিরণ্যলোকে নীত হয়ে সূর্যের মধ্যে পরমপুরুষকে দর্শন করে।
যে আদিত্য সূর্য ব্যাপ্ত হয়ে বিষ্ণুরূপ ধারণ করে কিরণরাশির দ্বারা জগৎ উদভাষিত করেন, যিনি জ্ঞানরাশিকে ধারণ করেন, যিনি জ্ঞানপ্রকাশক বাক্যকে ধারণ করেন, সেই বিষ্ণুর ব্যাপকত্বই সর্বযজ্ঞস্বরূপত্ব। তাই ঋষি বলিয়াছেন, দেবকাম মানুষেরা যে পথ ধরে গমন করে আহ্লাদিত হন, আমিও যেন সেই পথ পাই। এই বিপুলগমণ বিষ্ণু আদিত্যের পরমপদে মধুর উৎসব। তিনিই আমাদের প্রকৃত বন্ধু।
আমাদের এই প্রকৃত বন্ধু সূর্য যেমন অন্ন-জল-আশ্রয় প্রভৃতির দাতা, তেমনি তিনি আমাদের অন্তরে আহ্লাদকর রসসৃষ্টির জন্য চন্দ্রকে ধারণ করেন। এই চন্দ্র যিনি আহ্লাদকর ভসের উৎস তিনি সোম নামেও অভিহিত। জলরূপ সোম যেমন প্রাণিমাত্রেরই আহ্লাদের কারণ, এই চন্দ্র সোমও তেমনি সকল প্রাণীর আহ্লাদের কারণ। এই সোমচন্দ্রের জন্য বিষ্ণু সূর্য মেঘের আগরণ উন্মোচন করে পৃথিবীতে চন্দ্রের স্নিগ্ধ কিরণরাশির প্রবেশের দাওর খুলে দেন। আর সকিল দেবরশ্মি সোমচন্দ্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে আনন্দলোকের ঐশ্বরিক আহ্লাদ বর্ধিত করেন। সূর্যের যে শোভন রশ্মি গোবৎ স্নিগ্ধ তা চন্দ্রে নমিত হয়ে চন্দ্রকে উজ্জ্বল করে। সূর্যের গো-রশ্মিকে ধারণ করেন বলে চন্দ্র ‘গন্ধর্ব’ নামেও পরিচিত। শরৎকালীন আকাশে চন্দ্রমার স্বিগ্ধ জ্যোৎস্নার স্পর্শে ঊর্ধ্বাকাশে শুভ্র ঘৃতবৎ মেধের নিরন্তর আনাগোনা যে স্বর্গীয় শোভা সৃষ্টি করে সেই ঐশ্বরিক আহ্লাদ আস্বাদন করেন কবি ও জ্ঞানী বিপ্রগণ। মানুষের মধ্যে যিনি সর্বধন ও সর্বভোগসম্পন্ন, যিনি অন্যের অধিপতি, সেই মানুষ মনুষ্যাসমাজে মনুষ্যনন্দের পরমানন্দের নিদর্শন। আর এই গন্ধর্ব বা চন্দ্রলোকের যে আনন্দ তা মনুষ্যলোকের সর্বোত্তম আনন্দের লক্ষণিত।
এতক্ষণ যা বলা হোল তা সবই ঋষিবাক্য। এই সূর্য, চন্দ্র, ও পৃথিবীকে ঘিরে প্রতি ঋতুতে ঋতুতে যে বিচিত্র পরিবর্তন সংঘটিত হয় এবং যা বারবার একই ভাবে আবর্তিত হতে থাকে তাকে লক্ষ্য করেই প্রতি ঋতুতে ভারতীয় জনজীবনে নানা উৎসব। এই উৎসবগুলি বিশ্বের সঙ্গে একাত্মভাবে অবস্থানের স্মারকমাত্র। ঋতুতে, ঋতুতে, কালে কালে সূর্যের ব্রতকর্মানুষ্ঠানেরই অনুকরণ বৈদিক যজ্ঞভূমিতে। সূর্যের উত্তরায়ণ শেষে পুনরায় দক্ষিণায়ন যাত্রার অনুকরণে রচিত উৎসব। আষাঢ় মাসে অম্বু বা বারিবর্ষণের সূচনাতে যখন পৃথিবী বীজধারণযোগ্যা হন, তখন হয় অম্বুবাচী উৎসব। বর্ষণশেষে বিশ্বকর্মা ও শারদীয় উৎসব। দক্ষিণায়ণে বর্ষণকালে দেবরশ্মিগণ যখন পিতারূপে জগৎপালনের জন্য বর্ষণকর্মে নিযুক্ত থাকেন তখন পিতৃযজ্ঞ উৎসব। সূর্য পুরুষ বা আত্মা এবং সূর্যকিরণরাশি স্ত্রী বা পালিকা শক্তি। তাই সূর্যের এক নাম গোপা আর কিরণরাশি গোপিগণ। এই সূর্যকে মন্ডলাকার ঘিরে কিরণরাশির নৃত্যই রাসলীলা। আরভ যেহেতু রাসলীলা আহ্লাদজনক তাই পূর্ণিমার স্নিগ্ধ জ্যোৎস্নায় রাস উৎসব। প্রতি সংক্রান্তিতে, সৌর ও চান্দ্রমাসে, পূর্ণিমা ও অমাবস্যায় এবং বিশেষ বিশেষ তিথিতে ভারতীয় জনজীবনে বিভিন্ন সমাজে যে উৎসব তা সকলই সূর্য ও চন্দ্রকে ঘিরে। ভারতীয় সমাজ ধর্ম দর্শন সাহিত্য পুরাণ স্মৃতিশাস্ত্র সকলই বেদের প্রভাবে প্রভাবান্বিত। ভারতীয় বিবাহ পদ্ধতি, আচার ব্যবহার, রীতিনীতি, গার্হস্থ ধর্ম, বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, সঙ্গীতশাস্ত্র প্রভৃতি সকলই এই চার বেদের দ্বারা প্রভাবান্বিত যে বেদের প্রধান আলোচ্য বিষয় আত্মা ও সূর্য। বোইদিক দেবতা অপুরুষবিধ হলেও বিচিত্রলীলাকারী বলে নানা মূর্তী পরিগ্রহও করতে পারেন কিন্তু তাই বলে মূর্তরূপেই তাঁর পূজা করতে হবে বা তাঁকে ভাবনা করতে হবে এমন কথা বেদের কোথাও বলা হয়নি। বেদে এমন কথাও বলা হয়নি যে, বেদবিদ্যা বিশেষ শ্রেণীর কুক্ষিগত। বরং বলা হয়েছে চে, বেদে সকলেরই অধিকার। যে যেমন গুণের অধিকারী সে সেরূপ কর্ম করে সংসারে জীবন যাপন করবে, কৃপণের মত ধনসঞ্চয় করবে না। মেঘ যেমন জলদান না করে অন্ধকার সৃষ্টি করে কৃপণের মত জনসম্পদ নিরুদ্ধ করে রাখে এবং ইন্দ্ররূপী সূর্য বজ্রের আঘাতে সে অন্ধকার নাশ করে জলধারা সকলের জন্য দান করেন, এই দৃষ্টান্তকে অবলম্বন করে ঋষি বলছেন, মনুষ্য সমাজে যে কৃপণের মত ধনসঞ্চয় করে মনুষ্য সমাজের গতি নিরুদ্ধ করে মনুষ্যজীবনে অন্ধকার হতাশা সৃষ্টি করে, তাকে ইন্দের মত বলযুক্ত হয়ে আঘাত করে’ সকলের জীবনের গতির জন্য বারিরাশির ধনবন্টন করে দিতে হবে। গুণ অনুসারে কর্ম করার জন্যই চতুর্বর্ণের সৃষ্টি। ব্রাহ্মণের পুত্র ব্রহ্মবিদ্যার অধিকারী না হলে সে সেই অধিকার হতে স্বভাবিকভাবেই বঞ্চিত হয়। যিনি ব্রহ্মতত্ত্ব জেনে অগ্নির মত সমাজকে সুপথে নিয়ে চলেন তিনি যথার্থ ব্রাহ্মণ। যিনি শাসকরূপে অধিষ্ঠিত থেকে সমাজকে ক্ষত বা আঘাত থেকে রক্ষা করেন তিনি যথার্থ ক্ষত্রিয়। যিনি বিশে বিশে অর্থাৎ প্রতি জনের সঙ্গে সন্বন্ধ রেখে প্রতি জনের প্রয়োজনীয় দ্রব্য বন্টনের ব্যবস্থা করে নিজ প্রয়োজন মেটাবার জন্য পারিশ্রমিক রূপে সামান্যলাভে সন্তুষ্ট থাকেন তিনি যথার্থ বৈশ্য। যিনি কায়িক পরশ্রমের দ্বারা সেবামূলক কাজের দ্বারা নিজ অন্ন সংস্থান করে সন্তুষ্ট তিনিই যথার্থ শূদ্র। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এ ব্যবস্থা সর্বত্রই বর্তমান, যদি না এই ব্যবস্থার বিকৃতসাধনের দ্বারা সমাজকে বিষাক্ত করে হয়। ঋষিও তাই বলছেন, ওহে সোম, আমার মেয়ে যব ভাঙ্গে, আমার ভাই বাণিজ্য করে, আর আমি স্তোত্র পাঠ করি, সুতরাং তুমিও তোমার ধর্ম কর; ইন্দ্রের জন্য জলরূপে ক্ষরিত হও।  এইভাবে বেদের বিষয়কে জেনে ঋক্। যজু, সাম, অথর্ববেদকে যিনি জানেন, যিনি নিয়মিত বেদ অভ্যাস করেন তিনি ক্রমমুক্তির সন্ধান পান যা তাঁকে আনন্দ দান করে, যা তাঁকে পাপমুক্ত করে।

~: আদি হনুমান চালিশা :~


 

~: আদি হনুমান চালিশা :~



দোহা
স্মরণ করি শ্রী গুরু চরণ নিজ মন মুকুর সুধার
করি বর্ণন রঘুনাথ যশঃ যাহা ফল দায়ক চার
বুদ্ধি তনু জানিয়া স্মরণ করি পবন কুমার
বল বুদ্ধি বিদ্যা দাও হে প্রভু হর মোর ক্লেশ আর মনের বিকার
চৌপাহী
জয় হনূমান জ্ঞান গুণ সাগর।
জয় কপিশ ত্রিলোক উজাগর।
রাম দূত তুমি অতি বলশালী।
অঞ্জনী পুত্র পবন সূত মহাবলী।
মহাবীর যে নাম তব তুমি বজরঙ্গী।
কুমতি নিবার প্রভু, সুমতির সঙ্গী।
কাঞ্চন বরণ তব, বেশ সুবেশা।
কানেতে কুন্তল, কুঞ্চিত কেশা।
হাতে তে বজ্র আর ধ্বজা বিরাজে।
কাঁধেতে মুঞ্জ, উপবীত সাজে।
শঙ্করাংশে জন্ম তব, হে কেশরী নন্দন।
তেজ প্রতাপ তব মহা জগ বন্দন।
বিদ্যাবান তুমি, তুমি অতি চতুর।
রাম কাজ করিবারে, আতুর।
প্রভু চরিত্র শুনিবার রাখ অভিলাষা।
রাম-লখন আর সীতায় দাও ভালবাসা।
সুক্ষ্মরূপ ধরি, অসুর সংহার।
শ্রী রঘুনাথ সকল কাজ সার।
আনি সঞ্জীবনী, সৌমিত্রে বাচাইলে।
রাঘবের মনে তুমি, হরষ আনিলে।
তব কাজে রঘুনাথ মুগ্ধ হইলো।
ভরত ভ্রাতা সম, আলিঙ্গন দিল।
স্বনকাদি  ব্রহ্মাদি, ঋষি মুনি যত।
তব গুন গাহে, নারদ সহিত।
যম কুবের, দিকপাল যেখানে।
কবি কৌবিদ তারে, কহিনা কেমনে।
সুগ্রীব উপকার, ততুমি যে করিলে।
রামে মিলায়ে তারে, রাজপদ দিলে।
তোমারি মন্ত্র যবে, বিভীষন মানিল।
লঙ্কেশ হইল  সে, সারা বিশ্ব জানিল।
সহস্র যোজন দূরে, থাকে যে ভানু।
ধাইলে লইতে তাহা, তুমি বীর হনু।
প্রভুমুদ্রিকা, রাখি মুখ মাঝে।
জলধি লঙ্ঘিলে, রঘুনাথ কাজে।
দুর্গম কাজ যত, জগতে আছে।
সুগম যে হয় তাহা তোমারি কাছে।
তুমি  যে দ্বারী, রাম দুয়ারে।
আজ্ঞা বিনা কেহ, প্রবেশিতে নারে।
তোমারি স্মরণে যে, সব সুখ পা-ই।
রক্ষক হ’লে তুমি, কোন ভয় না-হি।
মহাতেজ তেজবনিকর জবে আপনারে।
ত্রিলোক যে কাঁপে, তব বিকট হুঙ্কারে।
ভূত পিশাচ, নিকট নাহি আসে।
তব নাম লয় যে, থাক তার পাশে।
নাশ করহ সব রোগ, হরহ সব পীড়া।
যে জন নিরত জপে, হনুমান বলবীরা।
সব সঙ্কট কর মোচন, তুমি বীর হনুমান।
মন ক্রম বচনে, ধরে যে ধ্যান।
সর্বোপরি রাম রাজার যে তপস্বী রূপ।
তাহার সকল কাজ কর তুমি  অনুপ।
যে কোন মনোরথ, যে জন করিবে।
তোমারি কৃপায় সে, অমিত ফল পাবে।
চারি যুগ তব, প্রতাপ-বাখানি।
জগতে খ্যাত তুমি, তাহা যে জানি।
সাধু সন্তের, তুমি রক্ষা কারি।
অসুর নিকন্দন, তুমি দুঃখ হারি।
অষ্ট-সিদ্ধি আর, নয়-নিধির দাতা।
আশীষ-করিলা তোমা, জানকী মাতা।
রাম রসায়ন, তোমারি পাশে।
রুঘুপতি সম মনে, রেখো এ দাসে।
তোমারি ভজন  গাহি, রাম পদ লভি।
জনম জনম ভুলি, দুঃখ যে সবই।
অন্তিম কালে স্থান, দিও রঘুবর পুরে।
রাম নাম সেথা যেন, পাই জপিবারে।
রাম নাম জপে যে, সে বড় চতুর
সঙ্কট মোচন হয়, হয় শোক সব দূর।
শোক তাপ মোচন করে, হরে সব পীড়া।
যে জন স্মরণ করে, হনুমান বল বীরা।
জয়-জয়-জয়, হনুমান জ্ঞান গোঁসাঈ ।
কৃপা করহ দেব, ভাঁতি  গুরু ভাই।
যে জন নিত্য পাঠ করে, হনুমান চালিশা।
মহাসুখ পায় হে, নাম রটে চহু দিশা।
জয় হনুমান, জয়-জয় মহাবীর।
“তারায়” তারাও প্রভু, এ ভব সাগর।
দোহা
পবন তনয় সম্কট হরণ, মঙ্গল মুরতি রূপ।
রাম লখন সীতা সহ, হৃদয়ে বসহ কপিসূত।
একবার প্রেমা-বেগে-বল।
সীতাপতি শ্রী রামচন্দ্রের জয়।
মহাবীর বজরংবলীর জয়।
পবনসুত হনুমানের জয়।
” সঙ্কট মোচন হনুমাস্টক ”
শিশুকালে যবে গ্রাসিলে রবি।
ত্রিলোক হইল আঁধার।
তাহা দেখি ত্রাসিত বিশ্ব সারা।
কেমনে এক সঙ্কট হইব পার।
দেবগন আসি যবে করিল বিনয়।
ছাড়ি দিলা রবি, করিলে উপকার।
কে নাহি জানে সঙ্কট হারি তুমি।
সঙ্কট মোচন নাম তোমার।
বালির ত্রাসে ত্রাসিত কপি সব।
বসে যবে গিরির উপর।
দেখাইলে তাহাদের পথ তুমি।
তুমিই হরিলে বিপদ।
মহাক্রোধে মহামুনি শাপিলে বালিরে।
দ্বিজ রূপে তুমিই তারিলে সে পাথার।
কে নাহি জানে সঙ্কট হারি তুমি।
সঙ্কট মোচন নাম তোমার।
আঙ্গাদ সাথে তুমি গেলে যবে।
সীতা খোঁজে সাগরের পার।
করিলে পন তুমি ফিরিবে না।
না লয়ে সন্ধান সীতার।
আনিলে সন্ধান রাম হৃদে।
করিলে প্রাণ সঞ্চার।
কে নাহি জানে সঙ্কট হারি তুমি।
সঙ্কট মোচন নাম তোমার।
রাবন ত্রাসে ত্রাসিতা  সীতার শোক নিবারিলে।
করিলে উপকার।
মারি নিশাচর অভয় যে দানিলে।
পুলক হইল  সবাকার।
মুদ্রিকা আনি দিলে শ্রীরামের শোক নিবারিলে।
তুমি গুনাধার।
কে নাহি জানে সঙ্কট হারি তুমি।
সঙ্কট মোচন নাম তোমার।
শক্তিবানে যবে লক্ষণ প্রাণ ত্যাজে।
হইলে তুমিই উপকারী।
পেয়ে এলে বৈদ্য সুষেনে গৃহে।
গন্ধমাদন আনিলে উপাড়ি।
আনিলে সঞ্জীবনী লখনে বাঁচাইলে।
হরষ  হইল সবার।
কে নাহি জানে সঙ্কটহারি তুমি।
সঙ্কট মোচন নাম তোমার।
রাবণ রণ আহ্বানিল যবে।
নাগ পাশে বন্ধন হইল সবার।
শ্রী রঘুনাথ সমেত সবে।
মায়া মোহে দেখিল আঁধার।
আনি খগেসে  তুমি কাটাইলে বন্ধন।
করিলে উপকার।
কে নাহি জানে সঙ্কট হারি তুমি।
সঙ্কট মোচন নাম তোমার।
বন্ধু সমেত জবে অহিরাবণ লয়ে রঘুনাথে।
পাতালে করিলা বিহার।
দেবগণে পুজি তুমি হে মহাপ্রভু।
সবে মিলি করি মন্ত্রণা বিচার।
সহায় হইলে তুমি সান্তনা দানিলে।
অহিরাবণে, করিলা সংহার।
কে নাহি জানে সঙ্কটহারি তুমি।
সঙ্কট মোচন নাম তোমার।
কাজ করিলে তুমি দেবগণের।
ধরিলে নাম মহাবীর।
” তারার ” – ও সঙ্কট তারো তুমি প্রভু।
তোমারে যে ডাকি হইয়া অধীর।
ক্লেশ হরো হনুমান মহাপ্রভু।
তুমি যে সঙ্কট হার।
কে নাহি জানে সঙ্কট হারি তুমি।
সঙ্কট মোচন নাম তোমার।
দোহা
লাল দেহ লালিমা লিপ্ত।
আর শোভে লাল লঙ্গুর।
বজ্রদেহ দানব দলন।
জয়-জয়-জয় কপিসুর।
ইতি শ্রী সঙ্কট মোচন হনুমাস্টক সমাপ্তম।
হনুমান আরতী
আরতী কর, আরতী কর, আরতী কর,
হনুমান লাল কী।
দুষ্টদলন, দুঃখ তারন শ্রী রাম দাস কী।
আরতী কর।
যাহারো বলে গিরিবর কাঁপে।
রোগ শোক যার নিকট না ঝাঁকে।
অঞ্জনী পুত্র মহাবলী কী।  আরতী করো।
সাঁধু  সন্তেরো তুমি রক্ষাকারি।
রাম কাজে তুমি মহাবেগধারী।
তোমারি বাহু বলে রামপদ পায় জানকী।
আরতী কর।
লঙ্কা জ্বালি তুমি অসুর সংহারো।
রাম সীতার সকল কাজ সারো।
আনি সঞ্জীবনী প্রাণ সঞ্চারো লক্ষণ  কী ।
আরতী কর।
বাম বাহু তত দানব দলনকারি।
ডান বাহুতে রাখ  লাজ সবার-ই ।
সুর নর মুনি জন গাহে যসঃ তব নাম কী।
আরতী কর।
জয়-জয়-জয় হনুমান মহাবলশালী।
কাঞ্চন থালে সাজায়ে আরতী।
শুভ্র কর্পূর জ্বালি।
করে আরতী মাতা অঞ্জলী হনুমান লাল কী।
আরতী কর….
হনুমান আরতী যে জন নিত্য গাহে।
বৈকুন্ঠবাসী হয়ে অন্তিমে অমর পদ পায়ে।
রাম পদ লভিতে তব নাম গাহে  — “তারা ” —
হে মারুতী।  আরতী কর……
——-সমাপ্ত——-

ত্রিসন্ধ্যা বা নিত্য কর্ম করার নিয়ম




ত্রিসন্ধ্যা বা নিত্য কর্ম করার নিয়ম


হরি ওম্ তৎ সৎ
ত্রিসন্ধ্যা বা নিত্য কর্ম করার নিয়ম
ত্রিসন্ধ্যা বা নিত্য কর্ম করার নিয়ম
১। সূর্যোদয়ের কমপক্ষে আধঘণ্টা আগে ঘুম থেকে উঠতে হবে। (একে বলে ব্রাহ্ম মুহুর্তে উঠা) ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে যাদের দীক্ষা হয়েছে তারা গুরু স্মরণ করে গুরু প্রদত্ত মন্ত্র এবং যাদের দীক্ষা বা (মন্ত্র) হয়নি তারা ঈশ্বরের যে কোন নাম জপ করবেন কমপক্ষে ১০৮ বার করে যতবার বেশি করা যায় জপ করবেন ও ঈশ্বরের স্মরণ ও মনন করবেন। এটা হল ১ম (সন্ধ্যা)। এটা সূর্য উঠার আধ ঘণ্টা পর পর্যন্ত চলতে পারে।
ঈশ্বর এক ও তাঁর নানা নাম, যেমন:
ওঁ (অউম্), দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর (শিব), রাম, কৃষ্ণ, রামকৃষ্ণ, হরি নারায়ণ ইত্যাদি।
তাই উক্ত যে কোন নামে তাঁকে ডাকতে হবে একেই বলে জপ। আর তাঁর রূপকে চিন্তা করাকেই বলে ধ্যান।
২। এভাবে স্নানের পর দুপুরে বা তার একটু আগে পরে একইভাবে কমপক্ষে ১০৮ বার করে যতবার পারবেন জপ করবেন। এভাবে ঈশ্বরের নাম করা ও তাঁর স্মরণ করা হল ২য় সন্ধ্যা।
৩। এভাবে সূর্যাস্তের অর্ধ ঘণ্টা পর থেকে শোবার আগে যে কোন সময়, তবে সন্ধ্যা আরতির সময় করা বেশী উত্তম। একই ভাবে ১০৮ বা অধিক বার তাঁর নাম জপ ও তাঁকে স্মরণ করতে হবে। এটি হল ৩য় সন্ধ্যা।
এভাবে ত্রিসন্ধ্যা করা একান্ত কর্তব্য (এছাড়াও শোবার সময় উঠার সময় হাই তোলার সময়, হাঁচি, কাশিতে সর্বদা তাঁর নাম করতে হয়)। মনে রাখতে হবে ঈশ্বরকে মহিলা, পুরুষ, আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা, শরীরের যে কোন অবস্থায় যে কোন কালে, যে কোন স্থানে এমনকি বাথরুমেও তাঁর নাম মনে মনে করবেন। কারণঃ
শ্রীমদ্ভাগবত গীতার ৮/৫ শ্লোকে আছে-
অন্তকালে চ মামেব স্মরণ মুক্তা কলেবরম্
য়ঃ প্রয়াতি স মদ্ভাবং য়াতি নাস্ত্যত্র সংশয়ঃ ।।
অর্থাৎ মৃত্যুকালে বা দেহত্যাগকালে যে ঈশ্বরকে স্মরণ করে বা তাঁর নাম করে সে আমার ভাব অর্থাৎ ঈশ্বরকে প্রাপ্ত হয় বা ঈশ্বর লাভ করে। মৃত্যু মানুষকে যে কোন সময় গ্রাস করে, বলে কয়ে আসে না। তাই যে কোন স্থানে দেহের যে কোন অবস্থায় মন্দিরে-শৌচালয়ে যে কোন স্থানে তাঁর নাম করা কর্তব্য।
তাই সর্বদা এমনকি শৌচ কালেও ঈশ্বরকে মনে মনে ডাকা (জপ) স্মরণ (ধ্যান) করা যায়। সুতরাং যাদের দীক্ষা হয়েছে তারা তার গুরু নির্ধারিত ইষ্ট মন্ত্র জপ করবেন। যাদের দীক্ষা হয়নি তবুও তারা ঈশ্বরের যে কোন নামে জপ করতে পারে যেমন- ওঁ (অউম্), দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর (শিব), রাম, কৃষ্ণ, রামকৃষ্ণ, হরি নারায়ণ ইত্যাদি যে কোন নামে ডাকবেন।
সঙ্গে গায়ত্রী মন্ত্র জানা থাকলে সেটি পারলে জপ করা যায়।
গায়ত্রী মন্ত্রঃ
ওঁ ভুঃ ভুবঃ স্বঃ তৎ সবিতুর্ বরেণ্যং ভর্গদেবস্য
ধীমহি ধিয়ো ইয়েনঃ প্রচোদয়াৎ ওঁ।
গায়ত্রীর অর্থঃ ভুঃ ভুবঃ স্বঃ অর্থ- স্বর্গ, মর্ত্য, অন্তরিক্ষ ব্রহ্মাণ্ড যাঁর থেকে উৎপন্ন হয়েছে সেই জ্যোতির্ময় পরমাত্মার ধ্যান করি, আমাদের বুদ্ধি (মতি) পরমাত্মার দিকে পরিচালিত হউক।
সর্বদা জানবেনঃ পূজার চেয়ে নামজপ বা নাম করা বড় তাঁর চেয়ে ঈশ্বরের ধ্যান করা আরো বড়। তাই জপ, ধ্যান অবশ্যই কর্তব্য। তবে বিশেষ দিনে পূজা করা কর্তব্য। জপ ধ্যান সর্বদা কর্তব্য।
তাছাড়াও শয়নকালে বা উঠার সময়, হাঁচি, কাশি, হাইতোলা যে কোন সময় যে কোন কর্মের শুরুতে ও শেষে তাঁর নাম করা কর্তব্য। যেমন- গা মোড়াবার সময় রাম রাম, হরিবোল, দুর্গা দুর্গা, হরে রাম হরে কৃষ্ণ ইত্যাদি। তাকে হরি ওঁ তৎ সৎ নামেও ডাকা যায়। আমাদের নিজ নিজ ব্যবসা ক্ষেত্র, কর্মক্ষেত্র ও যানবাহনে চলাচলে সর্বত্র বসে বসে বা হাটতে হাটতে ত্রিসন্ধ্যার সময় হলে মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকতে পারি। নাম করতে পারি।
তাই এখন থেকে আমাদের সকলের শ্লোগান হোকঃ
সম্প্রাদায় যার যার, সনাতন ধর্ম সবার।
ইষ্ট যার যার, সৃষ্টিকর্তা সবার।
লেখাটি পাঠিয়েছেন: শুভদ্বীপ।

রথযাত্রা



   

রথযাত্রা


রথযাত্রা/Ratha yatra
রথযাত্রা/Ratha yatra
মানুষের শরীরটাই যেন একটা রথ । আমরা দেখি, কঠোপনিষদে সেই রথের এক অপূর্ব বর্ণনা । আমাদের শরীর-রূপ রথখানি বিজয়পথে অবিরাম ছুটে চলেছে । মানবদেহের ইন্দ্রিয়গুলি হচ্ছে এই রথের ধাবমান ঘোড়া । আমাদের বুদ্ধি-রূপ সারথি, জন-রূপ লাগাম জুড়ে দিয়ে ইন্দ্রিয়-রূপ ধাবমান ঘোড়াগুলির গতিকে সবলে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে । আর সেই রথের অধিপতি হচ্ছে আত্মা, যা কিনা অচঞ্চল শান্ত মূর্তিতে রথোপরি বিরাজিত, রথের গতিবেগ তাঁকে আদৌ স্পর্শ করছে না । অনেক পন্ডিত মনে করেন শ্রীশ্রীজগন্নাথকে নিয়ে এই রথযাত্রা উৎসব ওই চিরন্তন আধ্যাত্মিক আদর্শকেই সর্বজনের কাছে পৌঁছে দেওয়ার এক লৌকিক আয়োজন । জনসমষ্টি নিয়েই জগৎ এবং সেই জনগণের অধিনায়ক হচ্ছে প্রভু জগন্নাথ । জগন্নাথ স্বামী “অঙ্গুষ্ঠ মাত্রঃ পুরুষঃ ” রূপে সকলের মধ্যে রয়েছেন । অনন্তকালের এই বিশ্বাস পোষণ করেই ভক্তরা মনি করেন, তাঁকে জানলে ও বুঝলে আর পুনর্জন্ম হয় না ।
জগন্নাথের রথযাত্রা উৎসব, যার মধ্যে দেবতা ও মানুষের আধ্যাত্মিক সম্পর্ক যেমন বিকশিত, তেমনি ভক্ত ও ভগবানের চিরন্তন ভালোবাসার সম্পর্কটিও প্রকাশিত । জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম এই তিন দেবতা তাদের রত্ন-সিংহাসন থেকে নেমে আসেন পথের ধূলায়, নেমে আসেন সর্বজনের মাঝে, ধরা দেন শ্রেণীহীন,বর্ণহীন এক বিশাল জনগোষ্ঠির হাতে এবং এভাবেই দেব মহিমায় অভিষিক্ত হয় মানব মহিমা । পুরীর রথযাত্রা ভারতীয় ধর্মজীবনের এক অতি প্রাচিন উৎসব । প্রকৃতপক্ষে পুরীর পরই আমরা মাহেষের বিখ্যাত রথ যাত্রার কথা স্মরণ করতে পারি । এছাড়াও মহিষাদলের রথযাত্রা, চন্দনদগরের রথযাত্রা এবং সাম্প্রতিক ইস্কনের রথযাত্রা বা উল্টোডাঙ্গার রাইকানু ভাগবত সমাজের জনপ্রিয় রথযাত্রার কথাও উল্লেখ করতে পারি । এই তালিকা অনায়াসেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করা য়ায় । কারণ, বাঙালীর জীবনে দোল-দুর্গোৎসব প্রভৃতির মতো রথযাত্রাও বাস্তব অর্থে গণউৎসব ।
আমরা বলে থাকি জগন্নাথদেবের মন্দির । কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কি তাই ? কারণ, মন্দিরের রত্নবেদীতে শ্রীশ্রীজগন্নাথ একা অবস্থান করে না । তাঁর সঙ্গে অবস্থান করেন বলাম, সভুদ্রা ও সুদর্শন চক্র । এক সঙ্গে চারজনেরই পুজো হয় । হিন্দু ধর্মের চারবর্ণের প্রতিক এই চারজন । বলরাম বা ব্রহ্মভদ্রের গায়ের রং শ্বেতবর্ণ- তিনি ব্রাহ্মণ । দেবী সুভদ্রার বর্ণ পীত, তিনি ধারণ করেছেন বৈশদের প্রতীক । শ্রীশ্রীজগন্নাথের গাত্রবর্ণ গাঢ়নীল বা কালো । অথাৎ, তিনি শূদ্রদের প্রতীক ধারণ করেছেন । আর রক্তবর্ণ সুদর্শন চক্র ক্ষত্রিয় প্রতীক । পুরীধামে জগন্নাথদেব যে রথে আরেহণ করেন, তাকে বলা হয় ‘নান্দীঘোষের রথ ‘, রথের সারথি মাতলি । শীর্ষদেশে থাকে একটি চক্র এবং চক্রের উপর দিকে শোভিত থাকে গড়ুর ও একটি বর্ণাঢ্য বিরাট পতাকা । বলরামের রথের নাম ‘তালধ্বজ ‘,রথের সারথি সুদ্যুন্ম । সুভদ্রার রথের নাম ‘দেবীরথ বা দর্পদলন ‘,এর সারথি অর্জুন । প্রতি বছর মাঘ মাসের বসন্ত-পঞ্চমী তিথিতে এই তিনটি রথের জন্য কাঠ সংগ্রহ শুরু হয় । আর অক্ষয় তৃতীয়ায় রথ তৈরির কাজ শুরু হয় । এইভাবে প্রতিবছর তিনটি রথ তৈরি করা হয় ।
জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা
জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা
জগন্নাথের এমন অসমাপ্ত রূপ কেন ? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে কয়েকটি পৌরাণিক কাহিনীর সন্ধান পাওয়া য়ায় । সেগুলির মধ্যে প্রচলিত একটি হল উল্লেখ করা হল । সেকালে মালব দেশের মধ্যবর্তী অবন্তিনগরের রাজা ছিলেন পুন্যবান ইন্দ্রদ্যুম্ন । তিনি ছিলেন শ্রীবিষ্ণুর পরম ভক্ত । ইনিই পুরীর মন্দির প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন । একদিন রাজা সপ্নাদেশ পেলেন, প্রভাতে পুরীর সমুদ্রতীরে চক্রতীর্থে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম শোভিত দারুব্রহ্মের সাক্ষাৎ পাওয়া য়াবে । তার মানে, সমুদ্রের স্রোতে ভেসে আসবে পবিত্র একটি কাঠ । সমুদ্রে ভেসে আসা সেই দারুব্রহ্মকে রাজা যেন ভক্তিভরে মন্দিরে নিয়ে আসেন । তবেই তাঁর মনোবাসনা পূর্ণ হবে । যথাসময়ে রাজা দারুব্রহ্মের সাক্ষাৎ পেলেন এবং তা মন্দিরে নিয়ে এলেন । সেই সময় হঠাৎই এক বৃদ্ধ শিল্পী এসে রাজদরবারে উপস্থিত হলেন । ইনি স্বেচ্ছায় মূর্তি তৈরির দায়িত্ব নিতে চান । এই বৃদ্ধ শিল্পীই যে ছদ্মবেশী বিশ্বকর্মা (মতান্তরে স্বয়ং শ্রীবিষ্ণু )- সেটা রাজা বুঝতে পারেননি । রাজা অপরিচিত এই বৃদ্ধ শিল্পীর হাতে মূর্তি তৈরির দায়িত্ব তুলে দিলেন । কিন্তু বৃদ্ধ শিল্পীর শর্ত মূর্তি তৈরির কাজ শুরু হওয়ার পর একশ দিন অতিক্রম হওয়ার আগে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন দরজা খুলতে পারবেন না, এবং শিল্পী নিজের মনে বন্ধ ঘরে ওই সময় কাজ করবেন ।
রাজা গভীর আগ্রহে বাইরে অপেক্ষা করতে থাকেন এবং দেখতে দেখতে পনেরদিন অতিক্রন্ত হয়ে গেল । হঠাৎ রাজা লক্ষ্য করলেন, বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে আর কোন শব্দ আসছে না । তিনি রীতিমত অধৈর্য হয়ে পড়লেন । শেষ পর্যন্ত মন্ত্রীদের শত অনুরোধ উপেক্ষা করে জোর করে দরজা খুলে মন্দিরে ঢুকে পড়লেন । কিন্তু কোথায় সেই শিল্পী -তিনি অদৃশ্য ।  মন্দিরে বিরাজ করছেন তিনটি অসমাপ্ত মূর্তি । এবার রাজা বুঝলেন, ওই শিল্পী স্বয়ং দেবতা ছিলেন । নিজ কৃতকর্মের জন্য তিনিঅনুতাপে ভেঙ্গে পড়লেন । শেষপর্যন্ত অপরাধের শাস্তি হিসাবে আত্মবিসর্জনের দৃঢ় সংকল্প নিলেন । সেই রাতেই তিনি আবার সপ্নাদেশ পেলেন – “আত্মহত্যা মহাপাপ, এটা তোমাকে মানায় না । তুমি ওই তিনটি অসমাপ্ত বিগ্রহকেই যথা নিয়মে পূজা কর ।” সেই থেকেই অসমাপ্ত রূপে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা পুরীতে পূজিত হয়ে আসছেন ।

শনিবার, ৪ জুলাই, ২০১৫

মাহেশ: বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রার উত্‍‌সব



  মাহেশ: বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রার উত্‍‌সব
দুর্গাপুজো বা কালীপুজোর মতো বিস্তৃত ক্ষেত্রে না হলেও রথযাত্রাও বাংলার একটি অন্যতম বড়ো উত্‍‌সব। প্রাথমিক ভাবে ওডিশার উত্‍‌সব হলেও শ্রীচৈতন্যর সূত্রে রথযাত্রা বঙ্গদেশেও যথেষ্ঠ জনপ্রিয় উত্‍‌সব হিসেবে পালিত হয়। বাংলায় রথযাত্রার সংস্কৃতি সম্ভবত এসেছে শ্রীচৈতন্যর নীলাচল অর্থাত্‍‌ পুরী গমনের পরে। শ্রীচৈতন্যর নির্দেশে চৈতন্যভক্ত বৈষ্ণবরা বাংলায় পুরীর অনুকরণে রথযাত্রার প্রচলন করেন। তবে ঠিক কবে কোথায় প্রথম রথটি টানা হয়েছিল তা বলা কঠিন। অনুমান করা হয়, হুগলি জেলার মাহেশ-এর জগন্নাথ মন্দিরের রথই বাংলার প্রাচীনতম রথ। তবে পুরীর মতো তিনটি নয়, একটি মাত্র রথেই জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম বিগ্রহ তুলে রথযাত্রা হয়।

mahesh_jagannathtemple01_gb.jpg
(মাহেশের মন্দির। ছবি–গৌতম বসুমল্লিক)
mahesh_jagannathtemple02_gb.jpg
(মাহেশের মন্দির। ছবি–গৌতম বসুমল্লিক)

মাহেশ-এর জগন্নাথ মন্দিরের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কেও রয়েছে তথ্যের অভাব। প্রাচীন কিংবদন্তি অনুসারে বলা হয়ে থাকে পুরীর দেবতা জগন্নাথ নাকি গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে মাহেশে এসে সেখানে থেকে যেতে মনস্থ করেন, এবং সেই অনুসারে সেখানে জগন্নাথ মন্দির তৈরি হয় ইতিহাস-পূর্বকালে। তবে ইতিহাস বলে, চৈতন্য সমসাময়িক জনৈক ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী পুরী গিয়ে জগন্নাথ বিগ্রহ দর্শন করে প্রীত হয়ে মাহেশের গঙ্গাতীরে এক কুটিরে জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম বিগ্রহ স্থাপন করেন। পরে শেওড়াফুলির জমিদার মনোহর রায় সেখানে প্রথম একটি মন্দির নির্মাণ করিয়ে দেন। সে মন্দির ভগ্ন হয়ে পড়লে কলকাতার বড়োবাজারের মল্লিক পরিবারের নিমাইচরণ মল্লিকের দানে ১২৬৫ বঙ্গাব্দে বর্তমান মন্দির তৈরি হয়। শ্রীচৈতন্যের নির্দেশে তাঁর ভক্ত কমলাকর পিপলাই আনুমানিক ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে বা তার কাছাকাছি সময়ে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারীর কাছ থেকে জগন্নাথ মন্দিরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমানেও তাঁর বংশধরেরা ওই মন্দিরের সেবায়েত হিসেবে নিয়োজিত আছেন।

mahesh_jagannathidol01_gbm.jpg
(মাহেশের মন্দিরে বিগ্রহ। ছবি–গৌতম বসুমল্লিক)
মাহেশের রথের সঙ্গেও কলকাতার সম্পর্ক গভীর। কথিত আছে মাহেশের প্রথম রথ নির্মাণ করিয়ে দেন জনৈক মোদক। কালের নিয়মে সে রথও জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। এক সময়ে কলকাতার শ্যামবাজার বসু পরিবারের কৃষ্ণরাম বসু একটি পঞ্চচূড় রথ তৈরি করিয়ে দেন। শুধু তাই নয়, তিনি মাহেশ জগন্নাথ মন্দির থেকে ‘মাসির বাড়ি’ পর্যন্ত রথ চলাচলের উপযোগী পাকা রাস্তা তৈরি করিয়ে দেন, সেই সঙ্গে রাস্তার দু’পাশে অনেকটা করে জায়গাও কিনে মন্দিরকে দান করেন বড়ো আকারের রথের মেলা বসবার জন্য। পরে তিনি হুগলির কালেক্টরির দেওয়ানি পেয়ে জগন্নাথ মন্দিরের জন্য প্রচুর ভূ-সম্পত্তির ব্যবস্থা করে যান, যার আয় থেকে মন্দিরের ব্যয়ভার নির্বাহ হতে পারে। কৃষ্ণরামের তৈরি কাঠের রথ আগুনে পুড়ে গেলে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র গুরুপ্রসাদ একটি নবচূড় রথ তৈরি করে দেন বটে কিন্তু পুণ্যের লোভে জনৈক ব্যক্তি ওই রথের তলায় আত্মহত্যা করলে রথটি পরিত্যক্ত হয়। গুরুপ্রসাদের জ্যেষ্ঠ পুত্র কালাচাঁদ নতুন একটি নবচূড় রথ তৈরি করে দেন। সেটি জীর্ণ হলে কালাচাঁদের জ্যেষ্ঠ পৌত্র বিশ্বম্ভর একটি কাঠের রথ তৈরি করিয়ে দেন। কিন্তু সেটিও আগুনে পুড়ে যায়।
বার বার আগুনে পুড়ে রথ নষ্ট হওয়া আটকাতে বিশ্বম্ভরের ছোটো ভাই কৃষ্ণচন্দ্র বসু ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রায় এক লক্ষ টাকা খরচ করে ১২৫ টন ওজনের পঞ্চাশ ফুট উঁচু এক বিশাল রথ নির্মাণ করিয়ে দেন সে যুগের অন্যতম নির্মাণ-স্থপতি সংস্থা ‘মার্টিন বার্ন কোম্পানি’কে দিয়ে আর সে রথের নকশা করেন ভারতের প্রথম পাশ্চাত্যধারার স্থপতি নীলমণি মিত্র।
মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক সম্প্রীতির কাহিনিও। সপ্তগ্রামের বোড়ো পরগনার জায়গিরদার নবাব খাঁনে আলি খাঁন গঙ্গাবক্ষে ভ্রমণ করবার সময় এক বার ঝড়ে বিপদগ্রস্ত হয়ে মাহেশ জগন্নাথ মন্দিরে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হন। মন্দিরের তত্‍‌কালীন সেবায়েত রাজীব অধিকারীর আপ্যায়ণে সন্তুষ্ট হয়ে নবাব খাঁনে আলি ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর অঞ্চলের জগন্নাথপুরকে মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের নামে লিখিত দলিলের মাধ্যমে নিষ্কর দেবোত্তর করে দেন। পরে মাহেশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকারে এলে কোম্পানিও সেই দলিলকে মান্যতা দিয়ে ওই পরগনা নিষ্কর ঘোষণা করে।

mahesh_rath01.jpg
(মাহেশের রথ। ছবি–গৌতম বসুমল্লিক)
বিত্তবান ভক্তিপরায়ণ ব্যক্তিদের সহায়তায় এক সময় মাহেশের জগন্নাথ মন্দির ও রথযাত্রা বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উত্‍‌সবে পরিণত হয়েছিল। কালের প্রভাবে আজ সেই শ্রেষ্ঠত্ব হয়ত বজায় নেই তবে এখনও বাংলার এই প্রাচীনতম রথযাত্রার উত্‍‌সব দেখতে লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। তার কৃতিত্ব মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের বর্তমান সেবায়েত কমলাকর পিপলাইয়ের উত্তরপুরুষ অধিকারীরা এবং রথের ব্যবস্থাপক শ্যামবাজার বসু পরিবারের সদস্যদেরই প্রাপ্য।
লিখেছেন-