শনিবার, ৪ জুলাই, ২০১৫

মাহেশ: বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রার উত্‍‌সব



  মাহেশ: বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রার উত্‍‌সব
দুর্গাপুজো বা কালীপুজোর মতো বিস্তৃত ক্ষেত্রে না হলেও রথযাত্রাও বাংলার একটি অন্যতম বড়ো উত্‍‌সব। প্রাথমিক ভাবে ওডিশার উত্‍‌সব হলেও শ্রীচৈতন্যর সূত্রে রথযাত্রা বঙ্গদেশেও যথেষ্ঠ জনপ্রিয় উত্‍‌সব হিসেবে পালিত হয়। বাংলায় রথযাত্রার সংস্কৃতি সম্ভবত এসেছে শ্রীচৈতন্যর নীলাচল অর্থাত্‍‌ পুরী গমনের পরে। শ্রীচৈতন্যর নির্দেশে চৈতন্যভক্ত বৈষ্ণবরা বাংলায় পুরীর অনুকরণে রথযাত্রার প্রচলন করেন। তবে ঠিক কবে কোথায় প্রথম রথটি টানা হয়েছিল তা বলা কঠিন। অনুমান করা হয়, হুগলি জেলার মাহেশ-এর জগন্নাথ মন্দিরের রথই বাংলার প্রাচীনতম রথ। তবে পুরীর মতো তিনটি নয়, একটি মাত্র রথেই জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম বিগ্রহ তুলে রথযাত্রা হয়।

mahesh_jagannathtemple01_gb.jpg
(মাহেশের মন্দির। ছবি–গৌতম বসুমল্লিক)
mahesh_jagannathtemple02_gb.jpg
(মাহেশের মন্দির। ছবি–গৌতম বসুমল্লিক)

মাহেশ-এর জগন্নাথ মন্দিরের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কেও রয়েছে তথ্যের অভাব। প্রাচীন কিংবদন্তি অনুসারে বলা হয়ে থাকে পুরীর দেবতা জগন্নাথ নাকি গঙ্গাস্নানের উদ্দেশ্যে মাহেশে এসে সেখানে থেকে যেতে মনস্থ করেন, এবং সেই অনুসারে সেখানে জগন্নাথ মন্দির তৈরি হয় ইতিহাস-পূর্বকালে। তবে ইতিহাস বলে, চৈতন্য সমসাময়িক জনৈক ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী পুরী গিয়ে জগন্নাথ বিগ্রহ দর্শন করে প্রীত হয়ে মাহেশের গঙ্গাতীরে এক কুটিরে জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম বিগ্রহ স্থাপন করেন। পরে শেওড়াফুলির জমিদার মনোহর রায় সেখানে প্রথম একটি মন্দির নির্মাণ করিয়ে দেন। সে মন্দির ভগ্ন হয়ে পড়লে কলকাতার বড়োবাজারের মল্লিক পরিবারের নিমাইচরণ মল্লিকের দানে ১২৬৫ বঙ্গাব্দে বর্তমান মন্দির তৈরি হয়। শ্রীচৈতন্যের নির্দেশে তাঁর ভক্ত কমলাকর পিপলাই আনুমানিক ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে বা তার কাছাকাছি সময়ে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারীর কাছ থেকে জগন্নাথ মন্দিরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বর্তমানেও তাঁর বংশধরেরা ওই মন্দিরের সেবায়েত হিসেবে নিয়োজিত আছেন।

mahesh_jagannathidol01_gbm.jpg
(মাহেশের মন্দিরে বিগ্রহ। ছবি–গৌতম বসুমল্লিক)
মাহেশের রথের সঙ্গেও কলকাতার সম্পর্ক গভীর। কথিত আছে মাহেশের প্রথম রথ নির্মাণ করিয়ে দেন জনৈক মোদক। কালের নিয়মে সে রথও জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে। এক সময়ে কলকাতার শ্যামবাজার বসু পরিবারের কৃষ্ণরাম বসু একটি পঞ্চচূড় রথ তৈরি করিয়ে দেন। শুধু তাই নয়, তিনি মাহেশ জগন্নাথ মন্দির থেকে ‘মাসির বাড়ি’ পর্যন্ত রথ চলাচলের উপযোগী পাকা রাস্তা তৈরি করিয়ে দেন, সেই সঙ্গে রাস্তার দু’পাশে অনেকটা করে জায়গাও কিনে মন্দিরকে দান করেন বড়ো আকারের রথের মেলা বসবার জন্য। পরে তিনি হুগলির কালেক্টরির দেওয়ানি পেয়ে জগন্নাথ মন্দিরের জন্য প্রচুর ভূ-সম্পত্তির ব্যবস্থা করে যান, যার আয় থেকে মন্দিরের ব্যয়ভার নির্বাহ হতে পারে। কৃষ্ণরামের তৈরি কাঠের রথ আগুনে পুড়ে গেলে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র গুরুপ্রসাদ একটি নবচূড় রথ তৈরি করে দেন বটে কিন্তু পুণ্যের লোভে জনৈক ব্যক্তি ওই রথের তলায় আত্মহত্যা করলে রথটি পরিত্যক্ত হয়। গুরুপ্রসাদের জ্যেষ্ঠ পুত্র কালাচাঁদ নতুন একটি নবচূড় রথ তৈরি করে দেন। সেটি জীর্ণ হলে কালাচাঁদের জ্যেষ্ঠ পৌত্র বিশ্বম্ভর একটি কাঠের রথ তৈরি করিয়ে দেন। কিন্তু সেটিও আগুনে পুড়ে যায়।
বার বার আগুনে পুড়ে রথ নষ্ট হওয়া আটকাতে বিশ্বম্ভরের ছোটো ভাই কৃষ্ণচন্দ্র বসু ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে প্রায় এক লক্ষ টাকা খরচ করে ১২৫ টন ওজনের পঞ্চাশ ফুট উঁচু এক বিশাল রথ নির্মাণ করিয়ে দেন সে যুগের অন্যতম নির্মাণ-স্থপতি সংস্থা ‘মার্টিন বার্ন কোম্পানি’কে দিয়ে আর সে রথের নকশা করেন ভারতের প্রথম পাশ্চাত্যধারার স্থপতি নীলমণি মিত্র।
মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক সম্প্রীতির কাহিনিও। সপ্তগ্রামের বোড়ো পরগনার জায়গিরদার নবাব খাঁনে আলি খাঁন গঙ্গাবক্ষে ভ্রমণ করবার সময় এক বার ঝড়ে বিপদগ্রস্ত হয়ে মাহেশ জগন্নাথ মন্দিরে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য হন। মন্দিরের তত্‍‌কালীন সেবায়েত রাজীব অধিকারীর আপ্যায়ণে সন্তুষ্ট হয়ে নবাব খাঁনে আলি ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর অঞ্চলের জগন্নাথপুরকে মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের নামে লিখিত দলিলের মাধ্যমে নিষ্কর দেবোত্তর করে দেন। পরে মাহেশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধিকারে এলে কোম্পানিও সেই দলিলকে মান্যতা দিয়ে ওই পরগনা নিষ্কর ঘোষণা করে।

mahesh_rath01.jpg
(মাহেশের রথ। ছবি–গৌতম বসুমল্লিক)
বিত্তবান ভক্তিপরায়ণ ব্যক্তিদের সহায়তায় এক সময় মাহেশের জগন্নাথ মন্দির ও রথযাত্রা বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উত্‍‌সবে পরিণত হয়েছিল। কালের প্রভাবে আজ সেই শ্রেষ্ঠত্ব হয়ত বজায় নেই তবে এখনও বাংলার এই প্রাচীনতম রথযাত্রার উত্‍‌সব দেখতে লক্ষ মানুষের সমাগম হয়। তার কৃতিত্ব মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের বর্তমান সেবায়েত কমলাকর পিপলাইয়ের উত্তরপুরুষ অধিকারীরা এবং রথের ব্যবস্থাপক শ্যামবাজার বসু পরিবারের সদস্যদেরই প্রাপ্য।
লিখেছেন-  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন