বুধবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৫

শুধুমাত্র তুলসী পাতার ব্যবহার করে সমাধান করুন ৬ রকমের শারীরিক সমস্যা by তত্ত্বরসামৃত জ্ঞানমঞ্জরী


 

শুধুমাত্র তুলসী পাতার ব্যবহার করে সমাধান করুন ৬ রকমের শারীরিক সমস্যা

 by তত্ত্বরসামৃত জ্ঞানমঞ্জরী
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা স্কুল's photo.
সেই প্রাচীনকাল হতেই নানা শারীরিক সমস্যা সমাধানে ব্যবহার হয়ে আসছে তুলসী পাতা। তুলসী পাতার ঔষধি গুণের কারণে এটি বহুকাল ধরেই সমাদৃত ঘরোয়া চিকিৎসায়। ছোটোখাটো নানা শারীরিক সমস্যা থেকে শুরু করে মারাত্মক দৈহিক সমস্যাও দূর করতে কার্যকরী এই তুলসী পাতা। আজ জেনে নিন শুধুমাত্র তুলসী পাতার ব্যবহারে নানা শারীরিক সমস্যা সমাধানের দারুণ উপায়গুলো।
১) গলাব্যথা ও সর্দি কাশি দূর করে
ঋতু পরিবর্তনের সময় ঠাণ্ডা লেগে সর্দি কাশি হয়ে যায় এবং গলা ব্যথার সমস্যাও দেখা দেয়। এই সমস্যা দূর করবে শুধুমাত্র তুলসীপাতা। নিয়মিত তুলসী পাতার রস পান করলে ও তুলসী পাতা ফোটানো পানি দিয়ে গার্গল করলে দ্রুত সমস্যার সমাধান পাবেন।
২) মাথাব্যথা উপশম করে
অনেক সময় মানসিক চাপ, মাইগ্রেন বা অন্যান্য অনেক কারণেই মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়। মাথাব্যথা থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে শুকনো তুলসী পাতা পানিতে ফুটিয়ে এই পানির ভাপ নিন। খুব ভালো ফলাফল পাবেন।
৩) দাঁতের সমস্যা দূর করে
দাঁতের জীবাণু দূর করতে তুলসী পাতার অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদানের জুড়ি নেই। এছাড়াও মাড়ির ইনফেকশন জনিত সমস্যা দূর করে তুলসী পাতা। সমস্যা দূর করতে শুধুমাত্র তুলসী পাতা চিবিয়ে রস শুষে নিন।
৪) জ্বর নিরাময়ে
১ মুঠো তুলসী পাতা ২ কাপ পানিতে ফুটিয়ে মধু মিশিয়ে চায়ের মতো পান করলে নানা ধরণের জ্বর যেমন ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ইত্যাদি থেকে রক্ষা পেতে পারেন। এছাড়াও সাধারণ ঠাণ্ডা জ্বর হলে তুলসী পাতার চা তা দ্রুত নিরাময়ে সহায়তা করে।
৫) কিডনির সমস্যা দূরে রাখে
তুলসী পাতার রস দেহ থেকে ক্ষতিকর টক্সিন দূর করার ক্ষমতা রাখে। নিয়মিত তুলসী পাতার রস পান করলে কিডনির সমস্যা, কিডনি ড্যামেজ এমনকি কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই কমে যায়।
৬) কানের ইনফেকশন দূর করে
অনেক সময় কানের বিভিন্ন কারণে কানের ইনফেকশনের সমস্যা দেখা দেয়। যদি প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা করতে চান তাহলে কানে কয়েক ফোঁটা তুলসী পাতার রস ফেলে দিন। তুলসী পাতার অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিইনফ্লেমেটোরি উপাদান কানের ইনফেকশন ও প্রদাহ দূর করবে।

শক্তিপীঠ বিমলা by কৃষ্ণকমল



শক্তিপীঠ বিমলা

 by কৃষ্ণকমল

কালিকাপুরাণ মতে, চার মহাপীঠ তন্ত্রসাধনার কেন্দ্র। এগুলির মধ্যে পশ্চিমদিকের পীঠটি হল ওড্ডীয়ন বা উড্ডীয়ন অঞ্চলের কাত্যায়নী। এই পীঠের ভৈরব জগন্নাথ। বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না, এই ওড্ডীয়ন বা উড্ডীয়ন হল আজকের ওড়িশা। আর এই কাত্যায়নী হলেন শ্রীক্ষেত্র জগন্নাথ ধামের রক্ষয়িত্রী দেবী বিমলা। পীঠশক্তি রূপে কাত্যায়নীর নাম পাওয়া যায় হেবজ্র তন্ত্র গ্রন্থেও। সেখানে তাঁকে বলা হয়েছে উড্র পীঠের ভৈরবী। আর সেখানেও ভৈরব হলেন জগন্নাথ।
দক্ষকন্যা সতীর উপাখ্যান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হিন্দুদের একাধিক পুরাণে ও লোককথায়। ব্রহ্মার মানসপুত্র দক্ষ প্রজাপতির ছিল আট মেয়ে। তাঁদের মধ্যে সবার বড়ো ছিলেন সতী। দক্ষ সতীকে শিবের হাতে সমর্পণ করেছিলেন। শিব শ্বশুরকে যথোচিত সম্মান করতেন না। বরং শ্বশুরের সামনেই তাঁর অশেষ গুণাবলির নিদর্শন স্থাপন করতেন। এজন্য দক্ষও তাঁর এই জামাইটির প্রতি বিশেষ সন্তুষ্ট ছিলেন না। সঙ্গে সঙ্গে সতীও হয়ে উঠেছিলেন বাবার বিশেষ অনাদরের পাত্রী। দক্ষ তাঁর অন্য মেয়ে-জামাইদের বাড়িতে ডাকতেন। কিন্তু শিব-সতীকে কখনই ডাকতেন না। সতীর বিয়ের কিছুদিন পরে দক্ষ এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। যথারীতি সেই যজ্ঞে তিনি অন্যান্য মেয়ে-জামাইদের আমন্ত্রণ জানালেন; শুধু ডাকলেন না শিব-সতীকে। সতী লোকমুখে জানলেন বাবার যজ্ঞ আয়োজনের খবর। তিনিও যজ্ঞস্থলে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। শিব বারণ করলেন। সতী শুনলেন না। অনাহত হয়ে সটান যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হয়ে দক্ষকে প্রশ্ন করে বসলেন, ‘বাবা, দেবাদিদেব মহাদেব কেন এই যজ্ঞে আমন্ত্রিত হননি?’ দক্ষ উত্তরে বললেন, ‘শিব সংহারের দেবতা। তাই তিনি অমঙ্গল বয়ে আনতে পারেন। তাছাড়া তাঁর বেষভূষাও ভদ্রজনোচিত নয়। তিনি শ্মশানচারী। ভূতপ্রেত তাঁর নিত্যসঙ্গী। সেই সব নগ্ন অনুচরবৃন্দের সম্মুখে তিনি নানান কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করে থাকেন। তাঁকে নিমন্ত্রণ করলে সমবেত সুধী দেবমণ্ডলীর সামনে আমাকেও অপ্রস্তুত হতে হবে। সেই কারণেই শিবকে এই যজ্ঞে নিমন্ত্রণ করা হয়নি।’ মঙ্গলময় জগদ্‌গুরু শিব। তায় তিনি তাঁর প্রাণের ঠাকুর। বাপের মুখে পতিনিন্দা সতীর প্রাণে শেলের মতো বিঁধল। যজ্ঞাগ্নিতে সতী-দেহ আহুতি দিলেন শিবানী। সতীর দেহত্যাগের সংবাদ পৌঁছালো দেবাদিদেবের কানে। ক্রোধে উন্মত্ত দেবাদিদেব বীরভদ্র, ভদ্রকালী প্রমুখ অনুচরবৃন্দকে দিয়ে দক্ষযজ্ঞ পণ্ড করালেন। কন্যার দেহত্যাগের কারণ দক্ষের মুণ্ডচ্ছেদ করলেন। তারপর সতীর অর্ধদগ্ধ দেহ কাঁধে তুলে উন্মত্তের মতো ছুটে বেড়াতে লাগলেন এলোক থেকে সেলোক। ত্রিভুবন ধ্বংস হওয়ার জোগাড় হল তাঁর ক্রোধের তেজে। তাই আসরে নামতে হল বিষ্ণুকে। সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ড খণ্ড করে ছড়িয়ে দিলেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে। সতীদেহের অন্তর্ধানে শান্ত হলেন শিব। বসলেন মহাধ্যানে।
এদিকে সতীর দেহের খণ্ডগুলি ভারতবর্ষের নানা প্রান্তে জন্ম দিল এক এক মহাপীঠের। শক্তিপীঠগুলির সংখ্যা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। পীঠনির্ণয় ও তন্ত্রচূড়ামণি মতে পীঠের সংখ্যা ৫১। শিবচরিত মতে ৫১ পীঠ ও ৫১ উপপীঠ। আবার সর্বশ্রেষ্ঠ শাক্ত পুরাণ দেবীভাগবত মতে ১০৮ পীঠ। বিমলা শক্তিপীঠের উল্লেখ বেশ কয়েকটি প্রধান গ্রন্থে পাওয়া যায়। আবার এই পীঠকে একাধিক নামেও চিহ্নিত করার প্রবণতা দেখা যায়।
তন্ত্রচূড়ামণি গ্রন্থের ‘পীঠনির্ণয়’ বা ‘মহাপীঠনির্ণয়’ অংশে উৎকলের বিরজা ক্ষেত্রকে শক্তিপীঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই পীঠের শক্তি বিমলা ও ভৈরব জগন্নাথ। সতীর নাভি এখানে পড়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে এই গ্রন্থে। তন্ত্রচূড়ামণিগ্রন্থেই অন্য একটি অধ্যায়ে অবশ্য বিমলাকে উপপীঠ বলে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এখানে সতীর উচ্ছিষ্ট পড়েছিল।তন্ত্রচূড়ামণি মন্দিরের অবস্থান উল্লেখ করতে গিয়ে ‘নীলাচল’ কথাটির উল্লেখ করেছে। নীলাচল বা নীলপর্বতের উল্লেখশিবচরিত গ্রন্থেও পাওয়া যায়। এই গ্রন্থেও বিমলা উপপীঠ। এখানকার শক্তি বিমলা ও ভৈরব জগন্নাথ। উল্লেখ্য, নীলাচল নামটি জগন্নাথ ক্ষেত্রের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে যুক্ত। সতীর উচ্ছিষ্ট পড়ার ঘটনার সঙ্গে জগন্নাথের উচ্ছিষ্ট ভোগে বিমলার পূজার কোনো যোগ থাকাও অসম্ভব নয়। তবে সেসব গবেষকদের আলোচনার বিষয়।
ফিরে আসি অন্যান্য তন্ত্র ও পুরাণ গ্রন্থগুলির আলোচনায়। কুব্জিকাতন্ত্র বলে, বিমলা ৪২টি সিদ্ধপীঠের একটি। এখানে সাধনা করলে সিদ্ধাই নামে এক ধরনের অলৌকিক ক্ষমতা লাভ করা সম্ভব। দেবীভাগবত পুরাণপ্রাণতোষিণী তন্ত্র ওবৃহৎ নীলতন্ত্র মতে, বিমলা ১০৮ শক্তিপীঠের অন্যতম। দেবীপুরাণ মতে, এখানে পড়েছিল সতীর পা। মৎস্যপুরাণ মতে, পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের বিমলা একটি শক্তিপীঠ। বামনপুরাণ মতেও এটি একটি মহাতীর্থ। মহাপীঠ নিরুপণ গ্রন্থে বিমলা ও জগন্নাথকে এই তীর্থের পীঠদেবতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মহাশক্তির ১০৮ পৌরাণিক নামের তালিকা নামাষ্টত্তরশতগ্রন্থেও পুরুষোত্তম ক্ষেত্রের বিমলার উল্লেখ পাওয়া যায়।
এখানে একটি প্রশ্ন ওঠা খুব স্বাভাবিক। ‘ভৈরব’ শব্দটি ও শাক্ত-তান্ত্রিক শক্তিপীঠের ভৈরব ধারণাটির সঙ্গে সাধারণত যে দেবতার সম্পর্ক তিনি দেবাদিদেব মহাদেব। নারায়ণ বা কৃষ্ণ নন। রামানুজী বিশিষ্টাদ্বৈত বা চৈতন্য-অনুসারী গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনে পুরীর জগন্নাথ নারায়ণ বা কৃষ্ণের স্বরূপ। বিভিন্ন শাস্ত্রেও দেবী বিমলাকে কাত্যায়নী, দুর্গা, ভৈরবী, ভুবনেশ্বরী বা একানংশা দেবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নারায়ণ-পত্নী লক্ষ্মী বা কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি শ্রীরাধার সঙ্গে বিমলার কোনো সাদৃশ্য আদৌ দেখা যায় না। তবে কেন জগন্নাথকে ভৈরব বলা হল? কেনই বা তিনি দুর্গা-স্বরূপা বিমলার ভৈরব হলেন?
এর দুটি ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। একটি অদ্বৈত একেশ্বরবাদী ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যা অনুসারে, শিব ও বিষ্ণু অভিন্ন। তাই শিবশক্তি দুর্গা ও বিষ্ণুশক্তি লক্ষ্মীও অভিন্না। সেই অর্থেই জগন্নাথ বিমলার ভৈরব। তবে এই ব্যাখ্যা ততটা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, বিমলার সঙ্গে  শৈব-তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের যোগ যতখানি, অদ্বৈত সম্প্রদায়ের যোগ ততখানি নয়। তন্ত্র মতে, জগন্নাথ নারায়ণ বা কৃষ্ণের নয়, শিবের রূপ। সেই জন্যই তিনি শিব-ভৈরব। মনে হয়, এই কারণেই তন্ত্রগ্রন্থগুলিতে জগন্নাথকে ভৈরব আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আর তাই শাক্ত বিশ্বাসে দেবী বিমলা হয়ে উঠেছেন পুরুষোত্তম শক্তিপীঠের প্রধান দেবী তথা জগন্নাথ মন্দিরের রক্ষয়িত্রী।
এ তো গেল শাস্ত্রের কথা। কিন্তু ইতিহাস কী বলে?
ইতিহাস বলে, বিমলা মন্দিরের ইতিহাস সম্ভবত বৈষ্ণব জগন্নাথ-কাল্টের চেয়েও প্রাচীন। জগন্নাথ মন্দিরের বর্তমান কাঠামোটি খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর পরে নির্মিত। অথচ বর্তমান বিমলা মন্দিরটি খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে পূর্ব গঙ্গ রাজবংশের রাজত্বকালে নির্মিত। তাও প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের ফলে জানা গিয়েছে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত আদি বিমলা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপরই গড়ে উঠেছে নবম শতাব্দীর এই মন্দিরটি। জগন্নাথ মন্দিরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রোহিণীকুণ্ডের পাশে অবস্থিত বিমলা মন্দিরের সঙ্গে মন্দির চত্বরের মুক্তিমণ্ডপের কাছে অবস্থিত নৃসিংহ মন্দিরের স্থাপত্যগত মিলটি বেশ লক্ষণীয়। মাদলা পাঁজি বলছে, দক্ষিণ কোশলের সোমবংশী রাজবংশের রাজা যযাতি কেশরী এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা।  উল্লেখ্য, এই বংশের রাজা প্রথম যযাতি (খ্রিস্টীয় ৯২২–৯৫৫) ও দ্বিতীয় যযাতি (খ্রিস্টীয় ১০২৫–১০৪০) উভয়েই “যযাতি কেশরী” নামে পরিচিত ছিলেন। মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী–বিশেষত পার্শ্বদেবতাদের মূর্তি ও মূল মূর্তিটির পিছনের পাথরের খণ্ডটি সোমবংশী শৈলীর নিদর্শন বহন করে। হয়তো এগুলি আদি মন্দিরেরই অংশ ছিল। তাই বলাই যায়, চত্বরের প্রধান মন্দির জগন্নাথ মন্দিরের তুলনায় দেবী বিমলার মন্দির প্রাচীনতর।
খ্রিস্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে আদি শঙ্করাচার্য পুরীতে গোবর্ধন মঠ স্থাপন করেছিলেন বিমলাকে প্রধান দেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। প্রথা অনুসারে, আজও গোবর্ধন মঠের অধ্যক্ষ পুরীর শঙ্করাচার্য বিমলা মন্দিরের প্রসাদ হিসেবে এক থালা মহাপ্রসাদ ও এক থালা খিচুড়ি ভোগ রোজ পেয়ে থাকেন। দ্য জগন্নাথ টেম্পল অ্যাট পুরী গ্রন্থের লেখক স্টারজার মতে, প্রাচীনকালে জগন্নাথ মন্দির ছিল ত্রিমূর্তি অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবপূজার কেন্দ্র। এই তিন দেবতার শক্তি তথা হিন্দুধর্মের প্রধান তিন দেবী সরস্বতী, লক্ষ্মী ও পার্বতীও তাই পূজিত হতেন জগন্নাথ মন্দিরে। তার মধ্যে দেবী পার্বতীর পূজা হত বিমলা রূপে। খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত পুরীতে শ্রীবিদ্যা উপাসনার প্রাবল্য লক্ষিত হয়েছে। পরবর্তীকালে বৈষ্ণবধর্ম জগন্নাথ মন্দির চত্বরে প্রাধান্য বিস্তার করে। কমে যায় শ্রীবিদ্যা ও শৈব-তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের প্রভাব। তবে এই প্রভাব একেবারেই অবলুপ্ত হয়নি। তান্ত্রিক পঞ্চমকার উপচারের বদলে বিমলা মন্দিরে নিরামিশ ভোগ ও দেবদাসী নৃত্যের প্রথা চালু হয়েছিল। তবে মাছভোগ দেবার প্রথাটি বজায় ছিল। রাজা নরসিংহদেব (শাসনকাল ১৬৩২–৪৭ খ্রিস্টাব্দ) মন্দিরে মাছ ও মাংস ভোগের প্রথা বন্ধ করে দেন। পরবর্তীকালে অবশ্য সেই প্রথা আবার চালু হয়। বর্তমানে বিমলা মন্দিরের জন্য সাধারণত আলাদা ভোগ রান্না করা হয় না। জগন্নাথের নিরামিশ ভোগই দেবী বিমলাকে নিবেদন করা হয়। শুধু দুর্গাপূজার সময় দেবীকে আমিষ ভোগ দেবার প্রথা রয়েছে। এই সময় খুব ভোরে গোপনে মন্দিরে পাঁঠাবলিও হয়। স্থানীয় মার্কণ্ড মন্দিরের জলাশয় থেকে মাছ ধরে এনে রান্না করে বিমলাকে নিবেদন করা হয়। পূজা হয় তন্ত্র মতে। এই সব অনুষ্ঠান ভোরে জগন্নাথ মন্দিরের দরজা খোলার আগেই সেরে ফেলা হয়। বৈষ্ণব ও স্ত্রী ভক্তদের এই সময় বিমলা মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। অনুষ্ঠানের অল্প কয়েকজন দর্শকই শুধু “বিমলা পারুষ” বা বিমলার আমিষ ভোগ পান। দেবী বিমলার ভক্তদের বিশ্বাস, দুর্গাপূজায় দেবী উগ্রমূর্তি ধারণ করেন। সেই সময় তাঁকে শান্ত করতে আমিষ ভোগ দিতেই হয়। যদিও এই মন্দিরে পশুবলি ও আমিষ ভোগ নিবেদন নিয়ে বৈষ্ণবদের আপত্তিও সুবিদিত।
বেলেপাথর ও ল্যাটেরাইটে নির্মিত বিমলা মন্দিরের স্থাপত্যশৈলীটি কলিঙ্গ স্থাপত্যশৈলীর দেউল রীতির নিদর্শন। মন্দিরের চারটি অংশ: বিমান (গর্ভগৃহ যে অংশে অবস্থিত), জগমোহন (সভাঘর), নাটমণ্ডপ (উৎসবাদির স্থান) ও ভোগমণ্ডপ (ভোগ ও বিনোদনের স্থান)। এর মধ্যে বিমান অংশটি রেখ দেউল। এর আকার শম্বুকাকৃতির চিনির ডেলার মতো। বিমলা মন্দিরের বিমানটির উচ্চতা ৬০ ফুট। গায়ে নানারকম ছবি খোদাই করা। কেন্দ্রীয় গর্ভগৃহে রাখা আছে দেবী বিমলার মূর্তিটি। দেবী এখানে চতুর্ভূজা। তাঁর তিন হাতে জপমালা, বরমুদ্রা ও অমৃতকুম্ভ। চতুর্থ হাতের বস্তুটি ঠিক কী, তা নিয়ে মতান্তর দেখা যায়। তবে দেবী দুর্গার যে মূর্তি আমরা সচরাচর দেখতে অভ্যস্থ, দেবী বিমলার মূর্তি আদৌ সে রকম নয়। শুধু দেবী পার্বতীর দুই সখি জয়া ও বিজয়াকে দেবী বিমলার দুই পাশে দেখা যায়। মূর্তির উচ্চতা ৪ ফুটের কিছু বেশি।
বিমানের বাইরে জগমোহন, নাটমণ্ডপ ও ভোগমণ্ডপও নানারকম খোদাইচিত্রে শোভিত। বিমানে তিনটি কুলুঙ্গি আছে। তার একটিতে অষ্টভূজা মহিষমর্দিনী ও আর একটিতে ষড়ভূজা চামুণ্ডার মূর্তি দেখা যায়। তৃতীয় কুলুঙ্গিটি খালি। সম্ভবত সেখানকার দেবীমূর্তিটি চুরি গিয়েছে। জগমোহনের বৈশিষ্ট্য এর পিরামিড-আকৃতির ছাদ। নাটমণ্ডপে দশমহাবিদ্যা সহ মোট ষোলোজন হিন্দু দেবীর মূর্তি অঙ্কিত আছে। ভোগমণ্ডপের কুলুঙ্গিতে আছে অষ্টভূজ গণেষ ও ষড়ানন কার্তিকের মূর্তি। এছাড়া ভোগমণ্ডপের প্রবেশপথের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে দেবী বিমলার বাহন গজসিংহ – পরাজিত হাতির উপর দাঁড়ানো বিজয়দর্পে গর্বিত এক সিংহ।
২০০৫ সালে বিমলা মন্দির সংস্কার করা হয়েছে। বর্তমানে এটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার ভুবনেশ্বর সার্কেল।
বিমলা মন্দিরের প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা। প্রতি বছর আশ্বিন মাসে ষোলোদিন ধরে মন্দিরে উদযাপিত হয় দুর্গাপূজা। পুরীর রাজা বিজয়াদশমীর দিন বিমলাকে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার রূপে পূজা করেন। এই মন্দিরের দুর্গাপূজার সবচেয়ে পুরনো উল্লেখটি পাওয়া যায়এখন নতুন দিল্লিতে রাখা কোণার্ক শিলালিপিতে (খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী)। এই শিলালিপির তথ্য অনুসারে, রাজা প্রথম নরসিংহদেব (রাজত্বকাল: ১২৩৮–১২৬৪) বিজয়াদশমীর দিন দুর্গা-মাধব (বিমলা-জগন্নাথ) পূজা করেছিলেন। হিন্দুধর্মের সনাতন বিশ্বাস, মেয়েরা কোমলস্বভাব। তাই বিমলার উগ্রমূর্তি মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা আজও দেখতে দেওয়া হয় না মেয়েদের।
বিমলা মন্দিরের একটি বৈশিষ্ট্য হল, জগন্নাথের প্রসাদী নারকেল বাটা, পনির ও মাখন দিয়ে শুকনো ভাত দিয়ে দেবী বিমলার নিত্যভোগের ব্যবস্থা। দুর্গাপূজার আমিষ ভোগ রান্নার ব্যবস্থা ছাড়া বিমলা মন্দিরের জন্য পৃথক ভোগ রান্নার ব্যবস্থা নেই। উচ্ছিষ্ট ভোগে হিন্দুধর্মে দেবদেবীর পূজা নিষিদ্ধ। তবে বিমলা মন্দিরে কেন এই ব্যবস্থা? ওড়িশায় একটি লোকশ্রুতি আছে এই নিয়ে। বৈকুণ্ঠে নারায়ণ-দর্শনে গিয়েছেন দেবাদিদেব মহাদেব। নারায়ণ তখন খেতে বসেছেন। মহাদেব দেখলেন, নারায়ণের থালা থেকে তাঁর ভোজ্যের কয়েক টুকরো উচ্ছিষ্ট পড়েছে মাটিতে। প্রসাদজ্ঞানে সেই উচ্ছিষ্ট তুলে মুখে দিলেন মহাদেব। সেসময় তাঁর অনবধানে কিছুটা লেগে রইল তাঁর দাড়িতে। কৈলাশে ফেরার পর মহাদেব দেখলেন, তাঁর পথ চেয়ে অপেক্ষা করে আছেন দেবর্ষি নারদ। নারদ দেখলেন মহাদেবের দাড়িতে লেগে আছে ভোজনাবশেষ। তিনি জানতেন, মহাদেব গিয়েছিলেন বৈকুণ্ঠে নারায়ণ-সন্দর্শনে। দুইয়ে দুইয়ে চার করলেন নারদ। তাঁর বুঝতে দেরি হল না, মহাদেব যাঁর শ্রেষ্ঠ ভক্ত, সেই নারায়ণেরই উচ্ছিষ্ট লেগে রয়েছে মহাদেবের দাড়িতে। তিনি চকিতে সেই উচ্ছিষ্ট তুলে নিয়ে মুখে দিলেন। ঘটনাটি নজর এড়ালো না শিবপত্নী পার্বতীর। ক্ষুণ্ণ হলেন তিনি। সোজা চলে এলেন বৈকুণ্ঠে। নালিশ জানালেন, নারায়ণ-প্রসাদে তাঁর ন্যায্য পাওনা থেকে দেবর্ষি তাঁকে বঞ্চিত করেছেন। তখন পার্বতীকে শান্ত করে নারায়ণ বললেন, “দেবী, দুঃখ কোরো না। কলিযুগে বিমলা রূপে নিত্য আমার প্রসাদ পাবে তুমি।” ভক্তেরা বলেন, সেই থেকে পুরীর মন্দিরে জগন্নাথের প্রসাদী অন্নে বিমলার পূজার নিয়ম।  উল্লেখ্য, জগন্নাথের প্রসাদ বিমলাকে উৎসর্গ করার পরই তা পায় মহাপ্রসাদের মর্যাদা।
শাক্ত সম্প্রদায়ের কাছে বিমলা মন্দির একটি মহাতীর্থ। ওড়িশাবাসী শাক্তদের কাছে বিমলা প্রধান শাক্ততীর্থ। তান্ত্রিকদের কাছে তো এই মন্দিরের গুরুত্ব মূল জগন্নাথ মন্দিরের চেয়েও বেশি।  জগন্নাথ মন্দিরের প্রথা অনুসারে, মূল মন্দিরে জগন্নাথকে পূজা করার বিমলাকে পূজা করা হয়।  প্রতিদিন এই মন্দিরের গর্ভমন্দির মুখরিত হয় শ্রীশ্রীচণ্ডী, আদি শঙ্করাচার্যের ‘দেব্যাপরাধক্ষমাপণ স্ত্রোত্র’ ও পুরুষোত্তম রক্ষিতের ‘বিমলাষ্টক স্তোত্রে’র সুরে। সন্তান আকুতি জানান, “মা, তোমার চরণসেবা করিনি কোনোদিন। কোনোদিন কিছুই ভালবেসে তুলে দিই নি তোমার হাতে। তবু আমাকে তোমার স্নেহের ছায়া থেকে কোনোদিন বঞ্চিত করোনি তুমি। আমি জানি, কুপুত্র জন্মায়, কিন্তু কুমাতা কখনও হয় না। আমার মতো পাপী আর কেউ নেই। তোমার মতো পাপঘ্নীও কেউ নেই। তাই হে জগজ্জননী, এরূপ জেনে যা উচিত তাই করো!”

(এই নিবন্ধটি লেখকেরই রচিত উইকিপিডিয়া নিবন্ধ অবলম্বনে অনুলিখিত। এটির সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত। লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্যত্র প্রকাশ আইনত নিষিদ্ধ। হিন্দু সংস্কৃতির প্রসার কল্পে অন্যত্র অবাণিজ্যিক প্রকাশের অনুমতি দেওয়া হয়। লেখকের সঙ্গে যোগাযোগের ঠিকানা (ফেসবুক): 

আত্মার বিজ্ঞান by কৃষ্ণকমল



     

আত্মার বিজ্ঞান

 by কৃষ্ণকমল
640Reincarnation
সমগ্র বিশ্ব এই ভ্রান্ত মোহে কর্মমুখর যে আমরা হচ্ছি এই দেহ। মানুষের সমগ্র কাজকর্মই তাদের জড় শরীরকে ঘিরে আবর্তিত হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় প্রথম যে বিষয়টি আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন, তা হচ্ছে, “আমরা এই দেহ নই, আমরা চিন্ময় আত্মা।” এমনকি সামান্য একটু চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারব যে আমরা এই দেহ নই।
আত্মা প্রকৃ্তপক্ষে কি?
আত্মা হচ্ছে জীবনী শক্তির এক চিন্ময় স্ফুলিঙ্গ যা প্রত্যেকটি দেহকে ক্রিয়াশীল করে, সেটিকে বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপ সম্পাদনে সক্ষম করে, ঠিক যেমন ইলেক্ট্রন কণার স্রোত তামার তারের মধ্যে প্রবাহিত হবার সময় শক্-এর সৃষ্টি করে। দেহকে একটি গাড়ীর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, আর আত্মাকে তুলনা করা যায় গাড়ীটির চালকের সংগে। আত্মা সেই জীবনের এক স্ফুলিঙ্গ, যার উপস্থিতির ফলে দেহকে জীবন্ত বলে মনে হয়, আর যখন আত্মা দেহটি ছেড়ে চলে যায়, তখন আমরা বলি যে লোকটি ‘মৃত’।
আত্মার অস্তিত্বের বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
আমারা কেবল জড় পদার্থ ও শক্তির সংগে সমন্বিতভাবে ‘বিজ্ঞান’ শব্দটিকে বুঝতে অভ্যস্ত। কিন্তু আরো এক উচ্ছতর মাত্রায় বিজ্ঞান রয়েছে, যা আত্মা ও অ-জড়, চিন্ময় শক্তি সম্বন্ধে আলোকপাত করে। আত্মা স্বরূপতঃ জড়াতীত, চিন্ময়, অপ্রাকৃত বস্তু। অন্য কথায়, আত্মা মূলগত ভাবেই জড় ইন্দ্রিয়ের প্রত্যক্ষণের পরিধির অতীত। জড়বিজ্ঞানের পরীক্ষা নিরীক্ষামূলক কলাকৌশলগুলি আত্মার অস্তিত্ব ‘প্রমাণ’ করার জন্য অপর্যাপ্ত, অনুপযুক্ত, ঠিক যেমন কানের দ্বারা আলোর অনুভব লাভের চেষ্টা বৃথা। কিন্তু অধ্যাত্ম-বিজ্ঞানের নিয়মবিধির অনুসরণের মাধ্যমে একে এক উচ্চতর বাস্তবতা বলে উপলব্ধি করা যায়। চরমে, সমগ্র পারমার্থিক সত্যই প্রকাশিত ও ‘প্রমাণিত’ হয় আভ্যন্তরিকভাবে, অনুভবের মাধ্যমে। তবু আত্মার উপস্থিতি উপলব্ধিতে নীচের বিষয়গুলি আমাদের সাহায্য করতে পারে।
১. সাধারণ জ্ঞান
যখন কেউ মারা যায়, আমরা বলি, “উনি চলে গেলেন।” এখন, কে চলে গেছেন? ব্যক্তিটির শরীর তো এখনো সেখানে শায়িত রয়েছে? সত্যটি হচ্ছে এই যে জীবনের উৎস আত্মা দেহটি ছেড়ে চলে গিয়েছে, এবং সেজন্য ব্যক্তিটিকে এখন বলা হচ্ছে মৃত।
২। স্বজ্ঞা-গত উপলব্ধি
আমাদের প্রত্যেকেরই একটি স্বজ্ঞাগত বোধ রয়েছে যে প্রকৃ্ত সত্তা বা ব্যক্তি, ‘আমি’ দেহ, মন ও বুদ্ধি থেকে আলাদা, পৃথক। আমরা বলি “আমার হাত,” “আমার মাথা” ইত্যাদি। এইভাবে আমরা দেহটির উপরের মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের ডগা পর্যন্ত ‘আমার এটা, সেটা’ বলে অভিহিত করতে পারি। এটি নির্দেশ করছে যে ঐসব বস্তুগুলি কোনো একজনের, কোনো মালিকের। চোখ, কান বা মস্তিষ্ক হচ্ছে কেবল কতকগুলি যন্ত্র, যেগুলির মাধ্যমে “আমরা” দেখি, শুনি, অথবা চিন্তা করি। এইসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি নিজেরা কোনো কিছু করতে পারে না। এমনকি একটি মৃতদেহেরও মস্তিষ্ক রয়েছে, কান রয়েছে, চোখ রয়েছে কিন্তু সেগুলি অকেজো, ক্রিয়াশক্তিরহিত। চালক, অর্থাৎ আত্মা এই দেহ-রূপ যানটিকে পরিত্যাগ করেছে বলেই এইসব যন্ত্রের কাজকর্ম সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে গেছে।
৩. চেতনা (Consciousness)
জীবন্ত দেহে রয়েছে চেতনা। ঠিক যেমন সূর্য তার চতুর্দিকে তাপ ও আলোকরশ্মি বিকিরণ করে, তেমনি আত্মাও সমগ্র দেহে চেতনা পরিব্যাপ্ত করে- পায়ের ডগা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত, সর্বত্র। দেহে পরিব্যাপ্ত এই চেতনাই আমাদেরকে চিন্তা, অনুভব বা চলাফেরা করতে সক্ষম করে। অতএব চেতনা হচ্ছে আত্মার লক্ষণ। চেতনার অস্তিত্বই একটি মৃত দেহের সঙ্গে জীবন্ত দেহের পার্থক্য সূচিত করে। এমন একটি যন্ত্র সহজেই তৈরী করা যেতে পারে, যেটির লেন্সে লাল আলো পড়া মাত্রই সেটি সাড়া দেয় ও তার থেকে এই তথ্য লেখা কাগজের টেপ বেরিয়ে আসেঃ “আমি লাল আলো দেখছি”, কিন্তু এই যান্ত্রিক সাড়া বা প্রক্রিয়ার মধ্যে কি সত্যি সত্যি কোনো অনুভবের স্পন্দন আছে, যা একটি চেতন জীব উপলব্ধি করে- যেমন কোনো মানুষের প্রভাতের রক্তিম সূর্যোদয় দেখে অনুভব করে? টমাস হাক্সলি যেমন যথার্থই বলেছেন, “এই বিশ্বে একটি তৃতীয় পদার্থ রয়েছে, অর্থাৎ চেতনা, যাকে আমি আদপেই কোনো জড় পদার্থ বা শক্তি বলে মনে করি না।” এই চেতনার অস্তিত্ব আত্মার অস্তিত্বকেই প্রমাণ করে।
৪। আসন্ন-মৃত্যুর অভিজ্ঞতা (N.D.E- Near Death Experience)
গবেষণায় সংগৃহীত তথ্যের দৃষ্টান্ত দ্বারা প্রদর্শিত হয় যে মন জড়ীয় মস্তিষ্ক ও দেহ হতে স্বতন্ত্র। এন.ডি.ই-র মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে দেহাতিরিক্ত অভিজ্ঞতা বা ও.বি.ই (আউট-অব-বডি এক্সপিরিয়েন্স), যেখানে বিভিন্ন মানুষ তাদের নিজেদের দেহ ও অন্যান্য দেহসংক্রান্ত ঘটনাবলীর কথা জানাচ্ছেন যা দেহাতীত কোন পটভূমিতে থেকে পর্যবেক্ষণ করা- তাদের গুরুতর অসুস্থতা, দৈহিক যন্ত্রণা বা অপারেশনের সময়, যখন তাদের দেহ থাকে অজ্ঞান বা ‘অচেতন’। এর আদর্শ দৃষ্টান্ত হচ্ছে, একজন হৃদরোগী শল্য চিকিৎসার পর কিঞ্চিৎ সুস্থ হয়ে অপারেশনকালীন সমস্ত ঘটনার আনুপূর্বিক বর্ণনা দিচ্ছেন, যেন বাইরে থেকে তিনি সেসব দেখেছেন। এইরকম অনুভবের সময় মেডিক্যাল অভিমত অনুসারে তার মস্তিষ্কের স্বাভবিক ক্রিয়াকলাপ বন্ধ হয়ে যায়- যন্ত্রে ব্রেন-ওয়েভের রেখাচিত্র বা গ্রাফের রেকর্ড থেকে তা স্পষ্ট বোঝা যায়, এবং ঐ রোগী তখন অজ্ঞান অবস্থায় থাকেন।
এন.ডি.ই নিয়ে পরিপূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত, নিখুঁত গবেষণা করে বহু ব্যক্তি তাদের রিসার্চ-রিপোর্ট উপস্থাপন করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, এমরি ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল স্কুলের প্রফেসর ও কার্ডিওলজিস্ট ডক্টর মাইকেল বি. স্যাবম্ প্রথমে এন.ডি.ই- সম্পর্কে ছিলেন অত্যন্ত সন্দিগ্ধ; কিন্তু ঐগুলির সত্যতা তদন্ত করে দেখার পর তিনি তাঁর মত পরিবর্তন করেন। কঠোর রিসার্চ-এর ভিত্তিতে ডক্টর স্যাবম্ লেখেন, “মানুষের মস্তিষ্ক যদি এই দুটি মৌলিক উপাদান দিয়ে নির্মিত হয়- ‘মন’ ও ‘মস্তিষ্ক’, তাহলে বহু মানুষের মৃত্যুকালীন অভিজ্ঞতার ঘটনা কি অত্যন্ত অস্থায়ী সময়ের জন্য হলেও মন ও মস্তিষ্কের বিচ্ছিন্নতাকেই প্রদর্শন করে না? এই দেহাতীত অভিজ্ঞতার জবানবন্দী আসলে প্রচলিত ধর্মীয় তথ্যের সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি সঙ্গগিপূর্ণ মনে হয়। সেই মন, যা শরীরস্থ মস্তিষ্ক হতে বিমুক্ত হয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে- সেটি কি আসলে মূলগতভাবে আত্মা হতে পারে, চরমে জড় শরীরের বিনাশের পরেও যার অস্তিত্ব থাকে অব্যাহত, ঠিক যেমন কিছু কিছু ধর্মীয় মতবাদে বলা হয়ে থাকে? আমার মনে হচ্ছে যে এই সব এন.ডি.ই-র রিপোর্টগুলি যে চরম প্রশ্নটিকে তুলে ধরেছে, এ হচ্ছে সেই প্রশ্ন।”
৫। পূর্বজন্মের স্মৃতি
বহু নিষ্ঠাবান গবেষক এই পূর্বজন্মের স্মৃতির উপর নিরপেক্ষ কঠোর ও নিয়মানুগভাবে বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার সাইক্রিয়াট্রির অধ্যাপক ইয়ান স্টিভেনসন শিশুদের দ্বারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথিত তাদের পূর্বজন্মের স্মৃতির উপর ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। শিশুদের দেওয়া তাদের পূর্ব জন্মের জন্মস্থান, তাদের পূর্ব নাম ও চেহারা, তাদের স্বজন-বর্গের ও অন্যান্য পরিচিতদের নাম পুনর্জন্মের সত্যতাকেই হুবহু সমর্থন করে। প্রফেসর স্টিভেনসন বহু সংখ্যক ঘটনার-বিবরণী একত্রিত করে সেগুলির সত্যতা যাচাইয়ে ব্রতী হন এবং সেই সাথে কোন প্রকার জালিয়াতি যাতে না হতে পারে সে ব্যাপারে তিনি কঠো সতর্কতা গ্রহণ করেন। তাঁর গবেষণা বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ উপস্থাপন করে যে চেতন আত্মা একটি জড় শরীর থেকে অপর একটি জড় শরীরে গমন করতে পারে, দেহান্তরিত হতে পারে। স্পষ্টতঃই, যখন একটি দেহের মৃত্যু হয় তখন তার মস্তিষ্কের কোষগুলি নষ্ট হয়ে যায়, এবং কোন রকম বাহ্যিক প্রক্রিয়ার সাহায্যেই সেগুলিকে আর অন্য আরেকটি মস্তিষ্কে প্রভাবিত করতে পারে না, সেইজন্য কখনই কোন মৃত মানুষের স্মৃতি কোনো শিশুর মস্তিষ্কে শারীরিকভাবে সঞ্চারিত হবার বা করবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। সেজন্য একটি শিশুর পূর্বজন্মের স্মৃতিচারণ এটিই প্রমাণ করে যে ঐ দেহস্থ ব্যক্তি আগের জন্মে ঐ পূর্বেকার দেহটি ব্যবহার করেছে, যার কিছু স্মৃতি সে অভিব্যক্ত করতে পারছে। অতএব সরলার্থ হচ্ছে এই যে চেতন আত্মা অবশ্যই এমন একটি সত্তা যা দেহস্থ মস্তিষ্ক থেকে পৃথক।
স্থুল দেহ ও সূক্ষ্ম দেহ
Fetus in the womb and Paramatma
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভগবদগীতায় বলেছেনঃ
অবিনাশী তু তদ্বিদ্ধি যেন সর্বং ইদং ততম্।
বিনাশং অবিনাশ্যস্য ন কিঞ্চিৎ কর্তুমর্হসি।।
“সমগ্র শরীরে পরিব্যাপ্ত রয়েছে যে অক্ষয় আত্মা, জেনে রেখো তাকে কেউ বিনাশ করতে সক্ষম নয়।” (ভ.গী.– ২/১৭)
ভগবদগীতা অনুসারে, আপনি এই দেহ নন। আপনি মন নন। আপনি বুদ্ধিও নন, আপনি মিথ্যা অহঙ্কারও নন। আপনি এই জড় দেহের সমস্ত জড় পদার্থের অতীত বস্তু। আপনি হচ্ছেন সেই চেতনা, সারা দেহে যা পরিব্যাপ্ত রয়েছে। আপনি হচ্ছেন চির অবিনাশী আত্মা। এরপর শ্রীকৃষ্ণ বলেন,
“ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খং মনো বুদ্ধিরেব চ।
অহঙ্কারং ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা।।”
“ভূমি, জল, বায়ু, আকাশ, মন, বুদ্ধি এবং অহঙ্কার- এই অষ্ট প্রকারে আমার ভিন্না জড়া প্রকৃতি বিভক্ত।” (ভ.গী. ৭/৪)
এই উপাদানগুলি সর্বদাই পরিবর্তনশীল। স্থূল শরীর তৈরী হয়েছে উপরোক্ত প্রথম পাঁচটি উপাদান দিয়েঃ ‘ভূমি’ বলতে বোঝায় সমস্ত কঠিন পদার্থকে। জল বলতে বোঝায় সমস্ত তরল পদার্থ। অগ্নি হচ্ছে আলোক ও তেজ (তাপ)। বায়ু হচ্ছে সমস্ত গ্যাসীয় পদার্থ। আকাশ হচ্ছে শূন্যস্থান (ইথার) এবং শব্দ। স্থূল দেহে এই পাঁচটি পদার্থ রয়েছে।
সূক্ষ্ম শরীর তিনটি সূক্ষ্ম উপাদান দ্বারা গঠিতঃ মন, বুদ্ধি ও মিথ্যা অহংকার (ভ্রান্ত ‘আমি’ বোধ)। প্রকৃত অহঙ্কার হচ্ছে এই উপলব্ধিঃ ‘আমি চিন্ময় আত্মা, কৃষ্ণের নিত্য দাস’। মিথ্যা অহঙ্কার হচ্ছে মোহগ্রস্ত অবস্থায় এই রকম চিন্তা করা, “আমি এই দেহ।” সূক্ষ্ম দেহ ও স্থূল দেহ হচ্ছে চেতনার উপর জড়ীয় আবরণ। এইরকম সূক্ষ্ম এবং স্থূল দেহে বদ্ধ একটি জীবাত্মাকে বলা হয় ‘বদ্ধ জীব’। যিনি এইরকম আবরণ থেকে মুক্ত এবং ভগবদ্ধাম প্রাপ্ত হন, তাঁকে বলা হয় মুক্তাত্মা। তারপর শ্রীকৃষ্ণ বলেন,
অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম্।
জীবভূতং মহাবাহো যয়েদং ধার্যতে জগৎ।।
“হে মহাবাহো ! এই নিকৃষ্টা প্রকৃতি ব্যতীত আমার আর একটি উৎকৃষ্টা প্রকৃতি রয়েছে। সেই প্রকৃতি চৈতন্য-স্বরূপা ও জীবভূতা; সেই শক্তি থেকে সমস্ত জীব নিঃসৃত হয়ে এই জড় জগৎকে ধারণ করে আছে।” (ভ.গী. ৭/৫)
ভগবানের শক্তিরাজি (God’s Energies)
অপরা (নিকৃষ্টা) জড়া শক্তি পরা (উৎকৃষ্টা, চিন্ময়)শক্তি
(Inferior Material Energy) (Superior Spiritula Energy)
স্থূল উপাদান সূক্ষ্ম উপাদান চিন্ময় দেহ (আত্মা)
(Gross Elements) (Subtle Elelments)
১. ভূমী (Earth) ১. মন (Mind) ১. সৎ (Eternal)
২. জল (Water) ২. বুদ্ধি (Intelligence) ২. চিৎ (Full of knowledge)
৩. অগ্নি(Fire) ৩. মিথ্যা অহঙ্কার (False Ego) ৩. আনন্দ (Full of Bliss)
৪. বায়ু (Air)
৫. আকাশ (Ether)
অনুৎকৃষ্টা অপরা শক্তি (জড় বস্তু) এবং উৎকৃষ্টা পরা শক্তি (আত্মা) উভয়ই পরমেশ্বর ভগবানের অধীন। আত্মাই হচ্ছে জীবন। শরীরটি সবসময়ই মৃত। ঠিক যেমন আপনি যদি হাতে দস্তানা পরেন এবং আঙুলগুলি সঞ্চালন করতে থাকেন, তাহলে দস্তানাকে জীবন্ত বলে মনে হতে পারে। ঠিক তেমনি আত্মা শরীরকে সঞ্চালন করে। শরীরটি সবসময়ই মৃত, এমনকি যখন আত্মা ঐ দেহের মধ্যে অবস্থান করতে থাকে তখনও দেহটি মৃত, কেননা শরীরটি কেবল কিছু মৃত অচেতন জড় পদার্থ দিয়ে তৈরী- মাটি, জল, আগুন, বাতাস, আকাশ এবং মন, বুদ্ধি ও মিথ্যা অহঙ্কার।
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
মানুষ কি কেবল একটি শক্তিশালী কম্পিউটার/ রোবট?
কম্পিউটারের হার্ডওয়ারটি কতকগুলি নির্দেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় (এই সব নির্দেশগুচ্ছের জন্য নানারকম ভাষাও রয়েছে, যেমন ফরট্রান, বেসিক, অথবা সি প্লাস প্লাস, ইত্যাদি)। এটি স্পষ্ট যে একটি কম্পিউটারকে কার্যক্ষম হওয়ার জন্য অবশ্যই একজন বুদ্ধিমান মানুষের দ্বারা নির্দেশিত (প্রোগ্রাম্ড্) হতে হয়। যে-ক্ষমতাই একটি কম্পিউটারের থাকুক না কেন, তা সে সংখ্যার কচকচি, তথা সংরক্ষণ, বস্তু সনাক্তকরণ, বা স্বাভাবিক ভাষার প্রক্রিয়াকরণ ইত্যাদি যাই হোক না কেন- তার সমস্ত ক্রিয়াক্ষমতাই একজন সংবেদনশীল চেতন মানুষ-এর দ্বারা প্রদত্ত। অন্য কথায়, যদি কম্পিউটারের কার্যনির্দেশক বা প্রোগ্রামার কম্পিউটার-সিস্টেমকে দুই যোগ দুই = পাঁচ, এই অঙ্ক কষতে প্রোগ্রাম করে রাখে, তাহলে কম্পিউটার ঐরকমই করবে। ঠিক সেই রকম দেখার ক্যামেরা-ব্যবস্থার সংগে সংযুক্ত কোনো কম্পিউটারকে যদি কোনো ঘনকাকৃ্তি (স্কয়ার)বস্তুকে গোল বলে সনাক্ত করার প্রোগ্রাম করা থাকে, তাহলে সেটি তাই-ই করবে। কম্পিউটার নিজে থেকে কোনো কিছুই বুঝতে পারে না। প্রোগ্রাম করা না থাকলে শুধু কম্পিউটারটি কেবল একটি বোবা যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়।
উদাহরণস্বরূপ, একটি নাটকাভিনয়ের কথা মনে করুন। একদল বিচারকমণ্ডলী নাটকটি দেখছেন, আর একটি ভিডিও ক্যামেরার দ্বারা পুরো নাট্যাভিনয়টি রেকর্ড করা হচ্ছে। বিচারক অভিনীত ঘটনাবলীকে রেকর্ড করতে তাঁর চোখকে ব্যবহার করছেন, আর ভিডিও ক্যামেরাটি সমস্ত ঘটনাবলীকে রেকর্ড করছে লেন্সের মাধ্যমে, যা চোখেরই যান্ত্রিক রূপায়ণ বা মেশিন-এনালগ। ঐ দর্শন –যন্ত্র এবং মানুষ – উভয় পর্যবেক্ষক তথ্য-উপাত্ত রেকর্ড করছে, কিন্তু মানুষ-পর্যবেক্ষক পরিদৃশ্যমান ঘটনাবলীকে “উপলব্ধি”-ও করছে। দৃষ্টন্তস্বরূপ, বিচারকমণ্ডলী একটি আবেগময় নাটকের সমগ্র আবেগমথিত দৃশ্যাবলী প্রত্যক্ষ করলেন, তাঁরা নাটকে গর্ব, দুঃখ, প্রকাশিত হতে দেখলেন। অপরদিকে ভিডিও ক্যামেরাটি আবেগ-অনুভূতিহীনভাবে কেবল কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঞ্চালন ও শব্দাবলী রেকর্ড করল। নাটক সমাপ্ত হলে বিচারকমণ্ডলী তাঁদের চোখের সামনে দৃশ্যায়িত দৃশ্য-চিত্রের ভিত্তিতে সর্বশ্রেষ্ঠ অভিনয়কারীকে নিরূপণ করলেন। কিন্তু ভিডিও ক্যামেরাটি কি ঐরকম কোন সিদ্ধান্ত দিতে সক্ষম- যদিও সে নাটকের প্রতিটি দৃশ্যই অভ্রান্তভাবে রেকর্ড করে রেখেছে?
পার্থক্যটি হচ্ছে এই যে, যদিও মানুষ ও ক্যামেরা – উভয় পর্যবেক্ষকই নাটকটি নিরীক্ষণ করছে, মানুষ হচ্ছে “চেতন”, কিন্তু ক্যামেরাটি সম্পূর্ণরূপে চেতনাহীন। সুতরাং মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যে প্রধান পার্থক্যটি হচ্ছে চেতনা- চেতনাগত পার্থক্য।
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
দেহ এবং আত্মার সম্বন্ধঃ দেহ একটি গাড়ীর মতো; আত্মা তার চালক
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
দেহকে একটি গাড়ীর সংগে তুলনা করা হয়, আত্মাকে তুলনা করা হয় চালকের সংগে। যদি একটি বোধশক্তিহীন কুকুরের ছানা রাস্তায় কোন একটি বড় গাড়ীকে আসতে দেখে, তাহলে সে এই ভেবে ভয় পেতে পারে যে ওটি একটি চার চাকার চলমান বড় কোন জন্তু। কিন্তু বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ বুঝতে পারে যে ওটি জন্তু নয়- একটি মৃত ব্যক্তিত্বহীন গাড়ী যা একজন চেতন চালকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। গাড়ীতে রাস্তা দেখার জন্য হেডলাইট রয়েছে, ঠিক যেমন আপনি আপনার চোখের সাহায্যে দেখেন। গাড়ী হর্ণের সাহায্যে আওয়াজ করে, আপনি মুখের সাহায্যে। গাড়ীর চারটি চাকা রয়েছে, আপনার দেহটির দুটি হাত ও দুটি রয়েছে। গাড়ীটি এক জায়গা হতে অন্যত্র চলাফেরা করে, আপনিও সেটাই করেন। কিন্তু গাড়ীতি থেকে চালক নেমে যাওয়ার পর ঐ গাড়ীটি এমনকি দশ লক্ষ বছরেও এক ইঞ্চি চলতে পারে না। ঠিক তেমনি, যখন একজন মানুষ মারা যায়, শরীরটি তখন পুরোপুরিই ঐ চালক-বিহীন গাড়ীটির মতোই – নিশ্চল, অনড়। সুতরাং আমরা যে দেহটিকে দেখি তা সবসময়ই মৃত। আত্মার উপস্থিতির জন্যই দেহকে জীবন্ত বলে মনে হয়। আত্মা যখন দেহ ত্যাগ করে, তখন দেহটি সম্পূর্ণ চলচ্ছক্তিহীন নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
একবার একজন বিজ্ঞানী একটি মৃতদেহ নিয়ে সেই দেহটির সমস্ত রাসায়নিক পদার্থকে পৃথক করে তার বাজার মূল্য যাচাই করে রিপোর্ট করে দিলেন যে ঐ দেহটির দাম দাঁড়াচ্ছে ১১০ টাকা (যদি সেটিকে বাজারে বিক্রী করা হয়)! তা, আপনি কি এমন মনে করেন যে আপনার মূল্য ১১০ টাকা? কিন্তু যখন একজন জীবিত ব্যক্তি তাঁর দেহের ছোট্ট একটি আঙুল হারায়, কিংবা তাঁর কিডনীটিকে বদলাতে হয়, তাহলে তিনি লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে থাকেন। জীবিত দেহের মধ্যে এমন কোন পদার্থ রয়েছে যা এই দেহকে এত মূল্যবান করে তোলে? আর একটি মৃতদেহে কি অনুপস্থিত যা ঐ দেহকে মূল্যহীন জঞ্জালে পরিণত করে? উত্তর হচ্ছেঃ আত্মা।
আত্মা (জীবনী শক্তি), উদ্ভিদ, পশুপাখী এবং মানুষ সকলের মধ্যেই রয়েছে। যেখানেই জীবন রয়েছে, সেখানে অবশ্যই আত্মা রয়েছে, কেননা আত্মাই হচ্ছে জীবন। অ্যামিবাই হোক, হাতি হোক, অথবা একটি মানুষ হোক- সব জীবিত দেহের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে আত্মা।
আধুনিক যুগঃ খাঁচা-পরিচর্যার সংস্কৃতি
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
শরীরকে একটি খাঁচার সংগেও তুলনা করা হয়, আর খাঁচার টিয়া পাখীকে তুলনা করা হয় শরীরস্থ আত্মার সংগে। ধরুন কেউ খাঁচায় এইভাবে একটি পাখী পুষে কেবল খাঁচাটিকে সুন্দরভাবে তদ্বির করছে – যেমন বিশেষ ডিজাইনের সুন্দর সোনার খাঁচায় পাখীটিকে রেখে প্রতিদিন খাঁচাটিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, খাঁচাটিকে ভালভাবে ঘষে-মেজে পালিশ করে ঝকঝকে করা ইত্যাদি। সকলে খাঁচাটিকে দেখে বিমুগ্ধ হয়ে প্রশংসা করে, এবং তাতে উৎসাহিত হয়ে সে আরো ভালভাবে খাচাটির যত্ন নিতে থাকে। কিন্তু এসব করতে গিয়ে সে পাখীটির কথা বেমালুম ভুলে যায়। পাখীটিকে দেয় না খাদ্য জল। ঠিক তেমনি, বর্তমান যুগে, আধুনিক সভ্যতায় প্রত্যেকে দেহের জন্য সমস্ত রকম আরাম স্বাচ্ছন্দ্য, বিলাসিতার ব্যবস্থা করার জন্য অত্যন্ত ব্যস্ত, কিন্তু আত্মার প্রয়োজনের দিকে কেউ দৃষ্টিপাত করছে না। সেজন্য প্রত্যেকেই পারমার্থিকভাবে ‘অনশনে’ ভুগছে। প্রত্যেকেই অন্ত্ররে বিষণ্ন, নিরানন্দ, এবং প্রত্যেকেই অজ্ঞান-তমসায় আবৃত হয়ে দুর্দশা ভোগ করছে। দেহ-খাঁচাটি যে অচিরেই ছাড়তে হবে, সে সম্বন্ধে অধিকাংশেরই কোনো জ্ঞান নেই, আর সে শিক্ষাও দেওয়া হচ্ছে না কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলে, বিশ্বজুড়ে এই দেহতদ্বিরের, খাঁচাটি-পালিশের গভীরতাহীন সংস্কৃতি গড়ে উঠছে।
আত্মা-সম্পর্কিত জ্ঞান
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
আত্মা অবিনশ্বর
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ । ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ ॥২৩॥ অর্থাৎ অনুবাদ:- আত্মাকে অস্ত্রের দ্বারা কাটা যায় না, আগুনে পোড়ান যায় না, জলে ভেজানো যায় না, অথবা হাওয়াতে শুকানোও যায় না।” ভ. গী. ২/২৩
আত্মা একজন ব্যক্তি
প্রত্যেক আত্মাই পৃথক পৃথক চেতনা-সমন্বিত এক একজন ব্যক্তি। আপনি আপনার দেহ, মন, বুদ্ধি ও মিথ্যা অহঙ্কার সম্বন্ধে সচেতন। আপনার মাথাব্যথা আমি অনুভব করতে পারি না, আবার আমি কি চিন্তা করছি আপনি তা জানেন না। কিন্তু ভগবান সৃষ্টির প্রত্যেকটি কণিকা সম্বন্ধে সচেতন; ন ত্বেবাহং জাতু নাসং ন ত্বং নেমে জনাধিপাঃ। ন চৈব ন ভবিষ্যামঃ সর্বে বয়মতঃপরম্ ॥১২॥ “এমন কোন সময় ছিল না যখন আমি, তুমি ও এই সমস্ত রাজারা ছিলেন না এবং ভবিষ্যতেও কখনও আমাদের অস্তিত্ব বিনষ্ট হবে না । ” (ভ. গী. ২/১২) মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ। মনঃষষ্ঠানীন্দ্রিয়াণি প্রকৃতিস্থানি কর্ষতি ॥৭॥ ‘এই জড় জগতে বদ্ধ জীবসমূহ আমার সনাতন বিভিন্নাংশ। জড়া প্রকৃতির বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ফলে তারা মন সহ ছয়টি ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রকৃতিরূপ ক্ষেত্রে কঠোর সংগ্র্রাম করছে।’ (ভ. গী. ১৫/৭)
3497_1
আত্মার রূপ আছে
আত্মা ‘নিরাকার নির্গুণ জ্যোতি’ বা ‘শূন্য’ কিছু মানুষ যেমন ভুল করে ভেবে থাকেন। আত্মা হচ্ছে এক সুন্দর ব্যক্তিত্ব, যার দেহ সৎ-চিৎ-আনন্দময়। আত্মা কেবল শক্তি মাত্র নয়, আত্মা একজন পূর্ণচেতন ব্যক্তি।
আত্মা শাশ্বত
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেনঃ ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্ নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ । অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে ॥২০॥ “আত্মার কখনও জন্ম হয় না বা মৃত্যু হয় না, অথবা পুনঃ পুনঃ তাঁর উৎপত্তি বা বৃদ্ধি হয় না৷ তিনি জন্মরহিত শাশ্বত, নিত্য এবং পুরাতন হলেও চিরনবীন। শরীর নষ্ট হলেও আত্মা কখনও বিনষ্ট হয় না।” (ভ. গী. ২/২০)।
আত্মার একটি শরীর রয়েছে, যা সৎ (নিত্য, শাশ্বত), চিৎ (জ্ঞান), আনন্দময়
আত্মা এই জড়জগতে এসেছে ভগবৎ-ধাম থেকে, আর এজন্য ভগবদ্ধামে ভগবানের সংগে প্রত্যক্ষভাবে সম্বন্ধিত হবার উপযোগী আত্মার একটি শাশ্বত, জ্ঞানময় ও আনন্দময় শরীর রয়েছে, যা অ-জড়, চিন্ময় – অর্থাৎ পূর্ণচেতন। কিন্তু আত্মা যখন একজন স্বাধীন ভোক্তা হতে আকাঙ্খা করে, তখন তাকে জড় জগতে প্রেরণ করা হয়, যেখানে তাকে একটি জড় শরীরে আবদ্ধ হতে হয়। এটা হচ্ছে ঠিক একটি টিয়া পাখীর (আত্মা) খাঁচায় (জড় দেহে) আবদ্ধ হওয়ার মতো। কেন আমরা দুর্দশা ভোগ করি? কারণ সচ্চিদানন্দময় আত্মা এমন একটি দেহে আবদ্ধ হয়েছে যা অসৎ-আচিৎ-নিরানন্দ, সুতরাং চিদরূপময় আত্মার ক্ষণস্থায়ী জরা-ব্যাধিগ্রস্ত জড়শরীরে অবস্থান অত্যন্ত অসামঞ্জস্যপূর্ণ। আর সেজন্যই আমাদের দুঃখ ভোগ করতে হয়- আমাদের যাবতীয় দুর্দশার এটিই মূল কারণ।
আত্মার অবস্থান হৃদয়-প্রদেশে
আত্মা সারা দেহকে চেতনা দ্বারা পরিব্যাপ্ত করে, ঠিক যেমন একটি বাতি সারা ঘরকে আলোয় ভরে দেয়। সারা ঘরকে যে বাতিটি আলোকোজ্জ্বল করে তুলছে, সেই বাতিটি ঘরের একটি কোণে থাকতে পারে। ঠিক তেমনি আত্মা হৃদয়-প্রদেশে (হৃৎ-পিণ্ডে) অবস্থান করেও সারা দেহে চেতনা পরিব্যাপ্ত করে। হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের সময় আত্মাকে দেহ থেকে সরানো যায় না, কেননা আত্মা চিন্ময় (অ-জড়)। দৃষ্টান্তস্বরূপ, যখন একটি গাড়ী থেকে স্টেপনী কিংবা রেডিয়েটর সরিয়ে নেওয়া হয়, তখন ঐ গাড়ীতে বসে থাকা চালকের কিছুই হয় না। ঠিক তেমনি একটি -হৃৎপিণ্ড (যে কেবল রেডিয়েটরের মতো একটি রক্ত-সঞ্চালনকারি যন্ত্র) অন্য আরেকটি দ্বারা প্রতিস্থাপন করলেও শরীরস্থ আত্মা তাতে প্রভাবিত হয় না।
আত্মা দেহ-পরিবর্তন করে
‘বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্ণাতি নরোহপরাণি । তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্য- ন্যানি সংযাতি নবানি দেহী ॥২২॥’ “মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে, দেহীও তেমনই জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে নতুন দেহ ধারণ করেন। ” (ভ. গী.- ২/২২)। ‘দেহিনোহস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা ।তথা দেহান্তরপ্রাপ্তির্ধীরস্তত্র ন মুহ্যতি ॥১৩॥’ “দেহীর দেহ যেভাবে কৌমার, যৌবন ও জরার মাধ্যমে তার রূপ পরিবর্তন করে চলে, মৃত্যুকালে তেমনই ঐ দেহী ( আত্মা ) এক দেহ থেকে অন্য কোন দেহে দেহান্তরিত হয়। স্থিতপ্রজ্ঞ পণ্ডিতেরা কখনও এই পরিবর্তনে মুহ্যমান হন না ।” (ভ. গী.- ২/১৩)
আত্মার আয়তন
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে এবং শ্রীমদ্ভাগবতে বীজ-রূপে জড়দেহে বিরাজিত আত্মার আয়তন বর্ণিত হয়েছে। যেমন শ্বেতাশ্বতর উপ-৫/৮-এ বলা হয়েছে, ‘বালাগ্র শতভাগস্য শতধা কল্পিতস্য চ। ভাগো জীবঃ স বিজ্ঞেয়ঃ স চানন্ত্যায় কল্পতে।।’ ‘কেশাগ্রকে শতভাগে ভাগ করলে তার যে আয়তন হয়, আত্মার আয়তনও ততখানি।’ এই হচ্ছে আত্মার বীজ-রূপী আয়তন। আত্মা জড়-ব্রহ্মাণ্ডে নানা শরীরে ভ্রমণকালে তার এই আয়তন থাকে। কিন্তু চিন্ময় জগতে ভগবদ্ধামে আত্মার একটি আদি, অপরূপ-সুন্দর সচ্চিদানন্দময় অর্থাৎ নিত্য, আনন্দময় ও জ্ঞানময় দেহ রয়েছে, যাকে বলা হয় আত্মার ‘স্বরূপ’ (আত্মার আদি নিত্য-সনাতন স্বরূপদেহ); পক্ষান্তরে জড় জগতে বদ্ধাবস্থায় আত্মার জড় শরীরকে বলা হয় বিরূপ বা বিকৃ্ত জড় রূপ)। তার নিত্য চিন্ময় স্বরূপে প্রত্যেক আত্মার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সংগে নিম্নোক্ত পাঁচটি রসের যেকোন একটিতে এক শাশ্বত মধুর সম্পর্ক রয়েছেঃ শান্ত রস, দাস্য রস, সখ্য রস, বাৎসল্য রস এবং মাধুর্য (দাম্পত্য) রস।
আত্মা অচিন্ত্য
চুলের অগ্রভাগের দশ হাজার ভাগের এক ভাগ এতই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যে এমনকি বর্তমানের সবচেয়ে শক্তিশালী ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপেও তা দেখা অসম্ভব। কিন্তু আমরা যদি এমনকি এই ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপের থেকেও অনেক শক্তিশালী কোনো অনুবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কারেও সক্ষম হই, এবং তার মধ্য দিয়ে আত্মাকে দেখার চেষ্টা করি, তবুও আমাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। আমরা এমনকি আমাদের চিন্তাকেও দর্শন করতে পারি না, তা পরিমাপ করতে পারি না। এমনকি মনও- যা হচ্ছে জড়ের সূক্ষ্ম রূপ- আমাদের কাছে অদৃশ্য, দৃষ্টির অগোচর, অব্যক্ত। সংজ্ঞানুযায়ী আত্মা মনেরও অতীত। এটি কেবল অব্যক্তই নয়, আত্মা আচিন্ত্য, অচিন্তনীয়। আপনি এমনকি এর- চিন্তাও করতে পারেন নাঃ অব্যক্তোহয়মচিন্ত্যোহয়মবিকার্যোহয়মুচ্যতে । তস্মাদেবং বিদিত্বৈনং নানুশোচিতুমর্হসি ॥২৫॥, “এই আত্মা অব্যক্ত, অচিন্ত্য ও অবিকারী বলে শাস্ত্রে উক্ত হয়েছে। অতএব এই সনাতন স্বরূপ অবগত হয়ে দেহের জন্য তোমার শোক করা উচিত নয় ।” (ভ. গী. – ২/২৫)।
দেহ ও আত্মার পার্থক্য
দেহ (Body) আত্মা (Soul)
১. অচেতন(Unconscious) ১. চেতন(Conscious), দেহে পরিব্যাপ্ত চেতনার উৎস;
২. জড়, আট রকম জড় উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত; ২.জড় উপাদানশূন্য, চিন্ময়, চিৎকণা
(তিন রকম চিদ্বিভাবের অভিভাজ্য রূপ)
৩.সদা পরিবর্তনশীল; প্রতিদিনই দেহের রূপান্তর হয় ৩.চির অ-পরিবর্তনীয়, অব্যয়; ‘অবিকারী’,
(বৃদ্ধি-ক্ষয় প্রভৃতি ৬টি পরিবর্তনের অধীন) বৃদ্ধি-ক্ষয় প্রভৃতি পরিবর্তনহীন;
৪. নশ্বর, বিনাশশীল, অনিত্য; ৪. অবিনশ্বর, নিত্য, শাশ্বত;
৫.ভগবানের বহিরঙ্গা, অপরা জড়া প্রকৃ্তির সৃষ্টি; ৫.ভগবানের অবিচ্ছেদ্য-অংশ,
তটস্থা শক্তি, পরা প্রকৃ্তি-সম্ভূত;
৬. স্থূল, পরিমাপযোগ্য; ৬. সূক্ষ্ম, অপরিমেয়;
৭. ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভবযোগ্য; ৭. জড় ইন্দ্রিয়ের অগোচর;
৮. অস্ত্রাদির দ্বারা বিনাশযোগ্য; ৮. অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য, অশোষ্য;
৯. অজ্ঞান বস্তুপিণ্ড; ৯. জ্ঞানময়; সকল গুণাবলীর আধার;
১০. ব্যক্তিত্বহীন যন্ত্র; ১০. মূল ব্যক্তি, ব্যক্তিত্বের কেন্দ্র;
১১. দুঃখ-ক্লেশের আধার নিরানন্দময়; ১১. আনন্দময়;
১২. পরিচালিত যন্ত্র (Car, Instrument); ১২. পরিচালক (Driver, user);
১৩. অনুভব- সামর্থ্যহীন; ১৩. অনুভূতিশীল; অনুভবের কেন্দ্র;
১৪. ইচ্ছা-দ্বেষ-বাসনা-সক্রিয়তা শূন্য; ১৪. ইচ্ছা-দ্বেষ-মান-অভিমান-বাসনা-সক্রিয়তা যুক্ত;
১৫. মিথ্যা অহঙ্কার নামক সূক্ষ্ম উপাদান সমন্বিত; ১৫. মিথ্যা অহঙ্কার বিহীন; প্রকৃ্ত আমি
(Real person);
১৬. জড় ইন্দ্রিয়যুক্ত; ১৬. চিন্ময় ইন্দ্রিয়যুক্ত;
১৭. মন, বুদ্ধি জড়; ১৭. মন, বুদ্ধি চিন্ময়;
১৮. অস্থায়ী পোশাক, ‘বিরূপ’। ১৮. শাশ্বত ব্যক্তি, ‘স্বরূপ’।
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
আমি কি ভগবান?
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
ভারতবর্ষে বর্তমানে অদ্বৈতবাদ, অর্থাৎ “আমি ভগবান। তুমি ভগবান। প্রত্যেকেই ভগবান” – এই দর্শন খুবই প্রচলিত। এই ধরণের দর্শন সেই সব বদ্ধ জীবাত্মাদের অন্তরে অসীম সন্তোষ প্রদান করে থাকে, যাদের ভোক্তা ও নিয়ন্তা হবার বাসনা প্রবল। বদ্ধ জীবাত্মা এমন ভোক্তা ও নিয়ন্তা হতে চায়। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এমন কেউ কি আছে যে নিয়ন্ত্রণাধীন, নিয়ন্ত্রিত নয়? সংজ্ঞানুসারে ভগবান পরম স্বরাট্, স্বাধীন স্বতন্ত্র পুরুষ এবং তিনি কারো নিয়ন্ত্রণাধীন নন। তিনিই পরম নিয়ন্তা। জীব অবিনাশী, শাশ্বত, অব্যক্ত এবং অচিন্ত্য, কিন্তু তবুও সে কি ভগবান হতে পারে? এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এই প্রশ্নের উত্তর আপনার পারমার্থিক জীবনের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
ভগবদগীতা এ-বিষয়ে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে জীব কখনো ভগবান নয়, কখনো সে ভগবান হতেও পারবে না; সমস্ত জীবসত্তা ও ভগবান নিত্য স্বতন্ত্র, যদিও উভয়ে চিন্ময়, সেজন্য গুণগতভাবে উভয়েই এক। জীব ক্ষুদ্রচিদ্ অণু, তাই সূর্যের কিরণকণা যেমন সূর্যের মতো ধর্ম বিশিষ্ট হলেও স্বয়ং সূর্য নয়, তেমনি চিৎ-কণাজীব ভগবানের মতো চিদ্ধর্ম বিশিষ্ট হলেও পরিমাণগতভাবে অত্যন্ত ক্ষুদ্র। ভগবদগীতায় এটাও দ্বার্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা হয়েছে যে এমনকি মোক্ষ বা মুক্তিলাভের পরও জীব আত্মস্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ভগবানে একীভূত হয়ে যায় না; প্রত্যেকের ব্যক্তিত্বই শাশ্বত। ভগবদগীতায় বলা হয়েছে (১৫/১৬)ঃ
দ্বাবিমৌ পুরুষৌ লোকে ক্ষরশ্চাক্ষর এব চ। ক্ষরঃ সর্বাণি ভূতানি কুটস্থোহক্ষর উচ্যতে।। “ক্ষর এবং অক্ষর দুই প্রকার জীব রয়েছে। এই জড় জগতে প্রতিটি জীবই ক্ষর এবং চিজ্জগতে প্রতিটি জীবই অক্ষর।”
এই জগতে আমরা যারা আমাদের শাশ্বত চিন্ময় স্বরূপ সম্বন্ধে অসচেতন, তারা ক্ষর (পরিবর্তনশীল দেহ-সম্পন্ন জীব)। এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রথম সৃষ্ট জীব ব্রহ্মা থেকে শুরু করে নগণ্য একটি পিঁপড়ে পর্যন্ত যে জীব-সত্তাই জড়ের সংস্পর্শে এসেছে, জড়-পদার্থের আবরণে তৈরী দেহাবয়ব ধারণ করেছে, সে ক্ষর। কিন্তু চিন্ময় জগতে দেহটি জড় পদার্থের তৈরী নয়, সেজন্য সেই দেহে কোনো পরিবর্তন হয় না; ঐ চিদ্-দেহ চির-শাশ্বত, অপরিবর্তনীয়। ঐ দেহে কখনো জরা-ব্যাধি-বার্ধক্য আসে না, সেই দেহের জন্ম-মৃত্যুও নেই। যে সব জীবসত্তা চিন্ময় জগতে পরম পুরুষ ভগবানের সংগে আনন্দবিলাসরত, তাঁরা সকলেই অক্ষর (অপরিবর্তনীয়), তাঁরা অনন্তকালের জন্য অপরিবর্তনীয় শাশ্বত আনন্দময় স্বরূপ-বিশিষ্ট।
উত্তম পুরুষস্ত্বন্যঃ পরমাত্মেত্যুদাহৃঢ়ঃ।।
যো লোকত্রয়মাবিশ্য বিভর্ত্যব্যয় ঈশ্বরঃ।।
“এই উভয় পুরুষ থেকে ভিন্ন, পুরুষোত্তম, পরমাত্মা রূপে সমগ্র বিশ্বে প্রবেশ করে তাদের পালন করেন” (ভ. গী. ১৫/১৭)। এখানে এটা অত্যন্ত সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে অগণিত জীবসত্তা-সমূহের মধ্যে কিছু জীব বদ্ধ, এবং অন্য সমস্ত জীব মুক্ত; এবং এই বদ্ধ ও মুক্ত (ক্ষর ও অক্ষর) উভয় জীবসত্তার মধ্যে পরম পুরুষোত্তম হচ্ছেন পরমাত্মা, ভগবান।
ভগবানের সংজ্ঞা:-
ভগবানের একটি সরল সংজ্ঞা হচ্ছে : 'জন্মাদাস্য য্তঃ' - "যাঁর থেকে সমস্ত প্রকাশিত হয়" (ভা: 1/1/1)৷ 'ভগবান' শব্দটি সংস্কৃত, এবং এর অর্থ বিশ্লেষণ করেছেন ব্যাসদেবের পিতা পরাশর মুনি- "(১) সমগ্র ঐশ্বর্য (ধনসম্পদ), (২) সমগ্র বীর্য (শক্তিমত্তা), (৩) সমগ্র য্শ, (৪) সমগ্র শ্রী (সৌন্দর্য, রূপবত্তা), (৫) সমগ্র জ্ঞান ও (৬) সমগ্র বৈরাগ্য যাঁর মধ্যে পূর্ণ-রূপে বর্তমান, সেই পরম পুরুষ হচ্ছেন ভগবান ৷" 'ভগ' শব্দের অর্থ ছয়টি ঐশ্বর্য (ষড়ৈশ্বর্য ) এবং 'বান' শব্দের অর্থ যুক্ত বা সমন্বিত৷ যেমন জ্ঞানবান অর্থ জ্ঞান-সমন্বিত, ধনবান শব্দের অর্থ ধন-সমন্বিত, তেমনি ভগবান শব্দের অর্থ যিনি সম্পূর্ণভাবে ৬টি ঐশ্বর্য সমন্বিত৷ ঐ সমস্ত ঐশ্বর্য অন্যকে আকর্ষণ করে- আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হবার এটিই রহস্য৷ কারও যে-পরিমাণে এই ঐশ্বর্য থাকে, তিনি ততটাই আকর্ষণীয় হন৷ এজগতে সকলেরই ঐসব ঐশ্বর্য কিছু কিছু পরিমাণে রয়েছে- কিন্তু কেউই সমগ্র ঐশ্বর্য-সম্পন্ন নয়৷ অনেক ব্যক্তি রয়েছেন যাঁরা অত্যন্ত ধনবান, খুব বলবান, খুব রূপবান, অত্যন্ত য্শস্বী, খুব জ্ঞানী এবং অত্যন্ত বৈরাগ্যবান, কিন্তু কেউই দাবী করতে পারে না যে তাঁর সমগ্র ধনৈশ্বর্য , সমগ্র বলবত্তা, সমগ্র সৌন্দর্য ইত্যাদি রয়েছে- একমাত্র ভগবানেরই এগুলি পূর্ণমাত্রায় রয়েছে৷ উপরোক্ত ছয়টি ঐশ্বর্য যাঁর পূর্ণ মাত্রায় আছে, তিনি নিশ্চয়ই 'সর্বাকর্ষক'৷ সংস্কৃত ভাষায় সর্বাকর্ষক শব্দের সমতুল শব্দ হচ্ছে 'কৃষ্ণ'৷
এইভাবে আমরা দেখতে পাই যে, শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র পুরুষ, যিনি শাশ্বত কাল ধরে, সম্পূর্ণভাবে সমস্ত ঐশ্বর্যের অধিকারী ৷ শ্রীকৃষ্ণই পূর্ণ ঐশ্বর্যসম্পন্ন পরমপুরুষ, পরমেশ্বর ভগবান৷ পূর্ণ মাত্রায় ঐশ্বর্য সমূহের অধিকারী হওয়ায় শ্রীকৃষ্ণ পরম আকর্ষক, তিনি সর্বাকর্ষক পরম পুরুষ, সেজন্যই তাঁর নাম 'কৃষ্ণ', যিনি সকলকে আকর্ষণ-পূর্বক আনন্দ প্রদান করেন৷
সংক্ষেপে ভগবান ও জীবের পার্থক্য
অতএব, সংক্ষেপে আমাদের উপলব্ধি করা উচিতঃ
***আমরা জীবাত্মা; ভগবান হচ্ছেন পরমাত্মা;
***আমরা অণূ (ক্ষুদ্র চিৎ-কণ); ভগবান বিভু (অসীম);
***আমরা কেবল আমাদের নিজ দেহটি সম্বন্ধে সচেতন, অবগত; ভগবান প্রত্যেকের সম্বন্ধে এবং সমস্তকিছু সম্বন্ধে অবগত;
***আমরা নিত্যকালের জন্য পরমেশ্বর ভগবানের প্রেমময় সেবক, দাস, আর ভগবান হচ্ছেন আমাদের প্রেমময় প্রভু;
***আমরা গুণগতভাবে ভগবানের সংগে অভেদ, কিন্তু পরিমাণগতভাবে আমরা ভগবান হতে ভিন্ন। এই বাস্তব সত্যকে স্বীকার করে নেওয়ার উপর আমাদের জীবনের পরম সার্থকতা লাভ নির্ভর করে।
পরমাত্মাঃ জীবাত্মার বন্ধু
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
যখন জীবাত্মা এই জড় জগতে পতিত হয়, তখন তাকে নানা দেহে দেহান্তরিত করা, তার তত্ত্বাবধান করা এবং তাকে পথনির্দেশ দানের জন্য পরমপুরুষ ভগবানের এক প্রকাশ জীবাত্মার সঙ্গী হন। শ্রীকৃষ্ণের এই প্রকাশ প্রতিটি জীবের হৃদয়ে বিরাজ করেন- ঈশ্বর সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেঃ অর্জুন তিষ্ঠতি- ভ. গী. ১৮/৬১), এবং প্রত্যেক পরমাণুর মধ্যেও তিনি প্রবেশ করেন (পরমাণুচয়ান্তরস্থং, ব্রহ্মসংহিতা – ৩৫)। তাঁকে বলা হয় পরমাত্মা।
দুই প্রকারের আত্মা রয়েছেঃ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র চিৎ-কণ (অণু-আত্মা, জীবাত্মা), এবং পরম আত্মা (বিভু-আত্মা, পরমাত্মা)। জীবাত্মার অর্থ একটি স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা, পরমাত্মার অর্থ একজন পরম ব্যক্তিসত্তা। জীবাত্মা ও পরমাত্মা উভয়েরই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব রয়েছে, উভয়েই ব্যক্তিত্ব সমন্বিত। উভয়ের মধ্যে পার্থক্য এই যে, জীবাত্মা কেবল একটি বিশেষ দেহে আবদ্ধ, পক্ষান্তরে পরমাত্মা সর্বত্র বিরাজমান। কঠোপনিষদেও একথা সমর্থিত হয়েছেঃ
অণোরণীয়ান্মহতো মহীয়ান্
আত্মাস্য জন্তোর্নিহিত গুহায়াম্।
তমক্রতুঃ পশ্যতি বীতশোকো
ধাতুঃ প্রসাদন্মহিমানমাত্মনঃ।।
“পরমাত্মা এবং জীবাত্মা উভয়েই বৃক্ষসদৃশ জীবদেহের হৃদয়ে অবস্থিত। যিনি সব রকম জড় বাসনা এবং সব রকমের শোক থেকে মুক্ত হতে পেরেছেন, তিনিই কেবল ভগবানের কৃপার ফলে আত্মার মহিমা উপলব্ধি করতে পারেন।”
পরমাত্মার কৃপার ফলেই অণু আত্মা ভিন্ন ভিন্ন দেহ প্রাপ্ত হয়। বন্ধু যেমন বন্ধুর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে, পরমাত্মাও তেমনি অণু আত্মার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। মুণ্ডকোপনিষদ্ ও শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদে আত্মা এবং পরমাত্মাকে একই গাছে বসে থাকা দুটি পাখির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একটি পাখী (জীবাত্মা) সেই গাছের ফল ভক্ষণ করছে, অপর পাখীটি (শ্রীকৃষ্ণ) তাঁর বন্ধুকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। এই দুটি পাখী গুণগতভাবে যদিও এক, (উভয়েই সচ্চিদানন্দময়, অ-জড়), তবুও তাদের একজন (জীবাত্মা) সেই জড়জগৎ-রূপ গাছের ফলের আকর্ষণে আবদ্ধ। কখনো সে তিক্ত ফল আস্বাদন করে শোক করছে, কখনো বা সে মিষ্টি ফল খেয়ে আনন্দ করছে। পক্ষান্তরে অন্যজন তার সখাটির কার্যকলাপ কেবল পর্যবেক্ষণ করে চলেছে।
অর্জুন হচ্ছেন ফল-আহারে রত পাখী, আর পর্যবেক্ষণরত পাখীটি হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। যদিও তাঁরা একে অপরের বন্ধু, তবুও তাঁদের একজন হচ্ছেন প্রভু এবং অন্যজন হচ্ছেন ভৃত্য। পরমাত্মার সঙ্গে তাঁর এই সম্পর্কের কথা ভুলে যাবার ফলেই জীবাত্মা-রূপ পাখী এক গাছ থেকে অন্য গাছে, অর্থাৎ এক দেহ থেকে আরেক দেহে ঘুরে বেড়ায়। এই জড়দেহ-রূপ বৃক্ষে জীবাত্মা তার কর্মের ফল-স্বরূপ নানা রকম দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে, কিন্তু যে মুহূর্তে সে পরমাত্মার নিত্য দাসত্ব বরণ করে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করে- সেই মুহূর্তে সে জড়বন্ধন থেকে মুক্ত হয় এবং তার সবরকম দুঃখ-কষ্টের নিবৃত্তি ঘটে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের চরণে অর্জুনের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আমরা এই তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারি। কঠোপনিষদ এবং শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে আছে-
সমানে বৃক্ষে পুরুষো নিমগ্নোহনীশয়া শোচতি মুহ্যমানঃ।
জুষ্টং যদা পশ্যত্যন্যমীশমস্য মহিমানমিতি বীতশোকঃ।।
“দুটি পাখী একই গাছে বসে, কিন্তু যে পাখীটি ফল আহারে রত, সে তাঁর কর্মের ফলস্বরূপ সর্বদাই শোক, আশঙ্কা এবং উদ্বেগের দ্বারা মুহ্যমান। কিন্তু যদি সে একবার তার নিত্যকালের বন্ধু অপর পাখীটির দিকে ফিরে তাকায়, তবে তার সমস্ত শোকের অবসান হয়, কারণ তার বন্ধু হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান এবং তিনি সমগ্র ঐশ্বর্যের দ্বারা মহিমান্বিত।”
পদ্মপূরাণ থেকে আমরা জানতে পারি যে এই ব্রহ্মাণ্ডে মোট ৮৪ লক্ষ ধরণের জীব-শরীর বা প্রজাতি রয়েছে এদের মধ্যে ৯ লক্ষ প্রজাতি হচ্ছে জলচর জীব, ২০ লক্ষ উদ্ভিদ প্রজাতি, কীট-পতঙ্গ হচ্ছে ১১ লক্ষ প্রজাতির, পাখী-প্রজাতি হচ্ছে ১০ লক্ষ, পশু ৩০ লক্ষ প্রজাতির, এবং মানুষ ৪ লক্ষ প্রজাতির। জীবসত্তা নানা প্রজাতির বিভিন্ন রকম জীব-শরীরে অবিরাম দেহান্তরিত হয়ে চলে, কিন্তু পরমাত্মা একান্ত সখার মতোই সর্বদাই তার সঙ্গে থাকেন; সেই জীবসত্তা মানবদেহে বা একটি কীট দেহে- যে দেহেই অবস্থান করুক না কেন, ভগবান সর্বক্ষণ তার সঙ্গে থাকেন।
পুনর্জন্ম কি?
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
জড় বস্তু ও চেতন পদার্থের স্বরূপ সম্বন্ধে শাস্ত্র আমাদেরকে তথ্য প্রদান করে। প্রথম যে মৌলিক জ্ঞান আমাদের শিক্ষা দেওয়া হয়, তা হচ্ছে এই যে, আমরা এই জড়দেহগুলি নই, আমরা চেতন আত্মা। আত্মার শরীর সচ্চিদানন্দময়, জড়-উপাদান-বিহীন; তাঁকে বলা হয় স্বরূপ দেহ। পরিবর্তনশীল জড় দেহটি জড় পদার্থের নির্মিত। প্রকৃ্তপক্ষে, জড় শরীরের দুটি ভাগ রয়েছে স্থূল ও সূক্ষ্ম। মাটি (কঠিন পদার্থ), জল (তরল), অগ্নি (তাপ), বায়ু (গ্যাসীয়) এবং আকাশ, এই পাঁচটি উপাদানে তৈরী হয় স্থূল শরীর। মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কার – এই তিনটি উপাদানে তৈরী হয় সূক্ষ্ম শরীর। এই দুটি শরীরই আত্মার জড় আবরণ বিশেষ। স্বরূপতঃ প্রতিটি জীবসত্তাই চিন্ময়, অজড় (সচ্চিদানন্দময়), কিন্তু যখন কোন জীব জড়জগৎকে উপভোগ করার বাসনা করে, তখন সে চিন্ময় জগৎ হতে জড় জগতে অধঃপতিত হয়। এভাবে যখন আত্মাকে জড় জগতে প্রেরণ করা হয়, তখন জড়জগতে তাকে জড় শরীরের আবরণে আচ্ছাদিত করা হয়, যাতে সে এই জড় পরিবেশের সংগে সামঞ্জস্যবিধান করে চলতে পারে, জড়জগতে বাস করতে পারে। ঠিক যেমন আপনি যখন বিদেশে যান, তখন সেই ঠান্ডা দেশের উপযোগী শীত বস্ত্র নিয়ে যান। জীবাত্মাকে প্রথমে মানব বা উচ্চতর কোনো প্রজাতির জন্ম দেওয়া হয়; কিন্তু সে যখন তার অপরাধ প্রবণতা সংশোধন না করে অধিকতর জড়-বিষয় সম্ভোগে আকাঙ্ক্ষিত হয়, তখন তাঁকে নিম্নতর প্রজাতিতে অধঃপতিত হতে হয়। তাঁর বিবর্তনের ধারায় ৮৪ লক্ষ প্রজাতির জীব শরীর- জলচর, উদ্ভিদ, পশু প্রভৃতি নানা জীব-শরীরে দেহধারণ করার পর তার মূল্যবান মানব-জন্ম লাভ হয়। তাকে বার বার দেহান্তরিত হওয়ার এই অন্তহীন চক্র হতে মুক্ত হবার আরেকটি সুযোগ প্রদান করা হয়। যে সরল প্রক্রিয়ায় জীব এক দেহ হতে অপর দেহে স্থানান্তরিত হয়, তাকে পূনর্জন্ম বলা হয়।
বাংলাতেই সংগৃহীত পুনর্জন্মের এক বাস্তব কেস-হিস্ট্রিঃ
(সূত্রঃ ভগবদগীতার সারতত্ব ছয় পর্বের প্রাথমিক পাঠক্রম )
ডঃ স্টিভেনসন-এর সংগৃহিত ২০০০ কেস-হিস্ট্রির একটি হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের একটি ছোট্ট মেয়ে। শুক্লার বয়স যখন মাত্র দেড় বছর, কথা বলতে শিখেছে কি শেখেনি, তখন থেকেই সে একটি বালিশ নিয়ে দোলনায় দোল দিত, আর বলত যে এটি হচ্ছে ‘মিনু’। সে বলত সে মিনু হচ্ছে তাঁর মেয়ে। পরবর্তী তিন বছরে শুক্লা তার পূর্ব জন্মের অনেক ঘটনাই স্মরণ করতে পারল, যাতে বোঝা গেল যে মিনু সত্যিই গত জন্মে তাঁর মেয়ে ছিল।
শুক্লা ছিল পশ্চিমবঙ্গের কম্পা গ্রামের এক রেলকর্মীর মেয়ে। সে কেবল তার মেয়ে মিনুর কথাই বলত না, ‘মিনুর বাবা’, অর্থাৎ তার স্বামী কথাও বলত, (অবশ্য তার নাম সে বলেনি- হিন্দু স্ত্রী তাঁর স্বামীর নামোচ্চারণ করে না)। সে তার গত জন্মের দুট
...